তুমুল করোনার মাঝেই ঝুঁকি নিয়ে গতবছর আগষ্টের এক দুপুরে টরেন্টোর পিয়ার্সন এয়ারপোর্ট নাবলাম। সুদীর্ঘ সাপের মতো আঁকাবাঁকা লাইন পেরিয়ে যখন ইমিগ্রেশন কাউন্টারে পৌঁছলাম, তখন হতাশ হয়ে জানতে পারলাম, আমাকে দু’দিনের হোটেল কোয়ারান্টাইন করতে হবে। যদিও দু’টি ভ্যাক্সিন নেয়া ছিল, তথাপি দ্বিতীয় ডোজ এবং ভ্রমণ তারিখের মধ্যে যথেষ্ট গ্যাপ না থাকায় এই সিদ্ধান্তের খড়গ নেমে আসল। অগত্যা বিফল মনোরথ নিয়ে টরেন্টো শেরাটনে চেক্ ইন করলাম।
টরেন্টোতে মেয়ে-নাত্নীদের সঙ্গে দেখা করতে প্রায় দু’মাস ধরে ছিল তুমুল প্রস্তুতি। ঢাকায় চলছিল ম্যারাথন “লকইন” নামক কাৰ্য অবস্থা। দোকান-পাট বন্ধ। রাস্তা-ঘাট ফাঁকা। তেমন কেনাকাটাও করতে পারলাম না। এর উপর ৭২ ঘন্টার পিসিআর টেষ্ট নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি । মনে হল, কিসের পাসপোর্ট? কিসের ভিসা? ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট-ই এখন পাসপোর্ট-ভিসা । দু’দিন হোটেলে বন্দীদশা থেকে মুক্ত হয়ে নীচে হোটেল লবিতে দেখা হল মেয়ে-জামাই আর নাত্নীদের সঙ্গে। আয়েশা, ঈশাল আনন্দে লাফাচ্ছে। অনেক দিন পর নানা-নানুর সঙ্গে দেখা হচ্ছে। লাগেজ ভর্তি করে গাড়ী ছুটল আজাক্সের দিকে, টরেন্টো থেকে সামান্য দূরে । কানাডার সবুজ আকাশ আমাকে সবসময় আকৃষ্ট করেছে। আগের বছরও এসেছিলাম এবং সামারেই। জুন- জুলাই-আগষ্ট সময়কাল চমৎকার রৌদ্র করোজ্জ্বল দীর্ঘ দিন। চারিদিক চোখ জুড়ানো দিগন্ত-বিস্তৃত মাঠ।
রাস্তার দু’পাশের ঘাসগুলো লনমোয়ার দিয়ে মিহি করে কাটা। চারিদেকে ফুলের ছড়াছড়ি। লাইট পোস্টেও ঝুলছে ফুলের কেয়ারী। মুগ্ধ বিস্ময়ে চারিদিক দেখতে দেখতে মেয়ের বাসায় পৌঁছলাম। ছিমছাম দোতালা ডুপ্লেক্স বাড়ী। সামনে এক চিলতে সবুজ ঘাস আর পাইন গাছ। পিছনের বাউন্ডারী দেয়াল ঘেঁষে উঁচু ঝাউ গাছের সারি। যদিও দেয়ালের ওপাশে রয়েছে ব্যস্ত হাইওয়ে, তথাপি গাছের দেয়াল থাকাতে তেমন শব্দ আসছে না। আয়েশা, ঈশালের স্কুল নটিংহাম যাওয়ার পথে বিশাল পার্ক। পার্ক জুড়ে ম্যাপল গাছের সারি। ল্যান্ড স্কেপিং করা মাঠে এক দারুণ দৃশ্য।
সরকারী চাকুরীতে থাকাকালে ৬/৭ বার কানাডায় এসেছিলাম মূলতঃ বিভিন্ন কনফারেন্স ও মিটিং এ যোগদানের জন্য। তখন ঢাকা-মন্ট্রিয়াল-ঢাকা করতে হত। এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল আবার হোটেল থেকে এয়ারপোর্ট। খুব একটা সামাজিক ভিজিট, শপিং করার সময় পেতাম না। বড়জোড় কানাডা টাওয়ারে উঠে টরেন্টো শহরটাকে পাখির চোখে দেখে নেয়া, ব্যাস। একবার ডিসেম্বরে এসে ত’ বেকুব হয়ে গেলাম। চারিদিক সাদা বরফে ঢাকা। টলটলে পানির লেকগুলোতে সাদা বরফের আস্তরণ। আই-স্কী করছে ছেলে মেয়েরা বরফের জুতো পড়ে। স্নো শাওয়ার কেমন
করে হয়? একবার রাতে হোটেলের জানালা দিয়ে দেখলাম ভেঁজা তুলোর মতো আকাশ থেকে ঝরছে স্লো। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম। গ্রীষ্মপ্রধান দেশে জন্ম নেয়া আমাদের প্রচন্ড গরম, বৃষ্টি আর বন্যায় সাথে বসবাস। স্নো ফ্লেক্স, স্নো শাওয়ার ত’ কল্পনারও বাইরে। সাধারণত: অক্টোবর থেকে এপ্রিল চলে শীতের প্রকোপ। তখন ঘর-বাড়ী সেন্ট্রাল হিটিং করে আর ফায়ার প্লেস চালিয়ে গরম রাখতে হয়। মেয়ের বাড়ীতে পৌঁছেই শুরু হল আশ-পাশের শপিং সেন্টার, পার্ক, অন্টারিও লেক ঘোরা-ফেরার এক অপূর্ব সুযোগ। শনিবার – রবিবার ছুটির দিনগুলোতে চলত আমাদের এই সাইট সিয়িং ট্যুর।
কানাডায় ক্রমশ: বাংগালীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। টরেন্টোর স্কারবরোতে গেলে ত’ রাস্তা- ঘাটে অহরহ বাংলা ভাষায় কথা শুনতে পেতাম। দোকানগুলোতে বাংলায় সাইনবোর্ড টাঙ্গানো । সাবওয়ে স্টেশন ভিক্টোরিয়া পার্কের মাঠে বৈশাখী মেলা, পৌষ মেলা অনুষ্ঠিত হত। সেখানে ছিল প্রচুর বাংগালীর সমাগম। দেশী জামা-কাপড়, বাংলা গান, রাত ভর বাংলা কনসার্ট ইত্যাদী। টরেন্টোর “বেগম পাড়া” তে রয়েছে দেশের রাজনীতিবিদ, কর্মকর্তাদের ক্রয় করা এ্যাপার্টমেন্ট, বাড়ী-ঘর।
ভাবছিলাম, এইবার কানাডায় এসে সময় কাটাবার জন্য কি করব? ছোটবেলায় ছবি আঁকার শখ ছিল। শুরু করলাম আঁকা-আঁকি। জল রং, তেল রং, এক্রিলিক, ব্রাশ কিনে বেশ কিছু ছবি আঁকলাম। ছবিতে প্রধানত: বাংলাদেশের নদী, পাল-তোলা নৌকা, ঘর-বাড়ী, জলাভূমি শোভা পাচ্ছিল। আবার ভাবলাম, কানাডায় যখন এলাম, কানাডার কিছু ছবি আঁকি না কেন? শুরু হল কানাডার লেক, গাছপালা, টাউনহাউজের ছবি আঁকা ।
সেপ্টেম্বরের শেষভাগে “ফলের” দেখা পেলাম। পাতাঝরার দিন। গাছের পাতাগুলো হলুদাভ, কমলা, লাল বর্ণ ধারণ করছে। বনে যেন আগুন লেগেছে। বেশ কিছু ফলের ছবি আঁকতে লাগলাম। আইকিয়ার ফ্রেমে ছবিগুলো বন্দি করলাম। শুরু হল আমার একক চিত্র প্রদর্শনী। এক এক করে টরেন্টো, সাদবেরী, বোস্টনে পাঁচটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল। সাদবেরীতে বন্ধুবর সাদেকুল তাঁর বাসভবনে আয়োজন করেছিল প্রদর্শনীটি। আরেকটি টরেন্টোতে মেয়ের বাসায়, বোস্টনে ভাগ্নীর বাসার লনে ইত্যাদী। ক্রেতারা ছিলেন মূলত: প্রবাসী বাংলাদেশীরা। এখন এরা সকলেই কানাডিয়ান নাগরিক এবং উন্নত জীবন যাপন করছেন ।
একটি প্রশ্ন আমার মাথায় ক্রমাগত ঘুরপাক খাচ্ছিল। কানাডায় প্রবাসী বাংগালীরা কেমন আছেন? প্রাথমিক পর্যায়ের দিনগুলো ছিল অবশ্যই চ্যালেঞ্জিং। বাসা-বাড়ী ভাড়া করা, বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করা, নিজেদের জন্য চাকুরী যোগাড় করা, গাড়ী কেনা ইত্যাদী। কানাডার চাকুরীর বাজার এখনও বিদঘুটে, অনেকটা বেমক্কা ধরনের। দেশ থেকে উচ্চ-শিক্ষিত ফ্যামিলিকে পি আর (পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট) স্ট্যাটাস দিয়ে নিয়ে আসা হয় এখানে। সবাই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পিএইচডি ধারী
ব্যক্তি। কিন্তু তাঁদের সমান মর্যাদার চাকুরী এখানে নেই । একজন ডাক্তারকে আবার প্রথম থেকেই লেখাপড়া করতে হয় কানাডায়। কঠিন পরীক্ষা পাশ করার পর বয়স বুড়িয়ে যায়। কাজের এনার্জি ফুরিয়ে আসে। আমি পিএইচডি ধারীকে বুচার শপে মাংস কাটতে দেখেছি, কন্ডোমিনিয়ামে সিকিউরিটি গার্ডের ডিউটি দিতে দেখেছি। বার্গার কিং, টিম হর্টন, ম্যাক ডোনাল্ডে ওয়েটারের চাকুরী করতে দেখেছি। একসময় তারা উন্নত জীবনের আশায় সন্তানদের মুখ চেয়ে এই অবমাননাকর জীবন বেছে নেন। আস্তে আস্তে সবকিছু সয়ে যায়। ধাতস্থ হয়ে আসে। দেশে আর ফেরা হয় না। কানাডার নাগরিকত্ব নিয়ে একসময় জীবন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে।
তবে ভারতীয় বংশদ্ভূত, চৈনিক বংশদ্ভূতদের বেশ কিছু “লিটল ইন্ডিয়া” “লিটল চায়না” দেখেছি, যেখানে পুরো এলাকাটি ঐ দেশের মানুষদের পদচারনায় মুখরিত। অবশ্য তাদের আগমন অনেক আগে থেকেই হয়ে আসছে। তাই চাকুরী, গাড়ী-বাড়ী, এমনকি পার্লামেন্টে এম পি, মন্ত্রী পদেও অনেকে আসীন। বাংলাদেশের সিলেটের বংশদ্ভূত ডলি বেগম, এম পি-র সাথে দেখা হল । তাঁকে অনুরোধ করলাম, দেশ থেকে আসা ইমিগ্রান্টদের চাকুরীর ব্যবস্থা করুন। সুযোগ করে দিন। সম মর্যাদার চাকুরী কি ভাবে তাঁরা পেতে পারেন, এজন্য নীতি নির্ধারণ করুন। বর্ণবাদ, শ্বেতকায়- অশ্বেতকায়, এশিয়ান-ইউরোপীয়ান চাকুরী প্রার্থীদের মধ্যে পার্থক্য দূর করুন। মেধার ভিত্তিতে একজন চাকুরী পেতে পারেন, এমন সুযোগ করে দিন। জানি নে, তিনি কদ্দূর তা করতে পেরেছেন।
আবার মাঝে মাঝে মনে হয় প্রবাসী বাংগালীরা হয়তো ভালোই আছেন। কানাডীয় নাগরিকত্ব পেয়েছেন। সন্তানদের পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্কুল-কলেজগুলোতে প্রায় বিনে পয়সায় লেখা-পড়া করাতে পারছেন। সন্তানেরা কম্পিটিটিভ চাকুরীর বাজারে ভালো করছেন। বাবা-মা রা নিজেদের জীবন দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর পৃথিবী নির্মাণ করে যাচ্ছেন।
প্রবাসী বাংগালীদের মধ্যে অনেক সাংস্কৃতিক বন্ধন দেখেছি। মসজিদ-ভিত্তিক ধর্মীয় শিক্ষা, নামাজ, রোজা, তারাবি, ঈদ উৎসবে মিলিত হতে দেখেছি। একদম ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে ভেসে যেতে দেখিনি। তবে বিয়ে-শাদীতে আজকাল বাংলাদেশের মতোই ভারতীয় হিন্দি গান-বাজনা চলছে। হেমন্তকাল শেষ প্রায়। ডিসেম্বরে পা দিয়ে টের পেলাম শীত জাঁকিয়ে বসেছে। চারিদিক ধূ ধূ সাদা বরফ। অনেক জামা-কাপড়, উলেন টাইট্স, টুপী পড়েও রেহাই নেই। একনাগাড়ে ৪/৫ দিন আকাশ মেঘলা করা, মন খারাপ করা দিন। ঝির ঝির করে বরফের কুচি ঝরছে। কানাডার বৈরী আবহাওয়া, নিজ গায়ে-গতরে পরিশ্রম করা এবং নিষ্ঠুর চাকুরীর বাজারে একবার মানুষ অভ্যস্ত হয়ে গেলে, মন বসে গেলে, আর দেশে ফেরা হয় না। দেশ তখন হয়ে যায়, সূদূর এক স্বপ্ন, যা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
Dr Mahfuzul Haque, a former Secretary of the Government of Bangladesh has been teaching for a decade and half as an Adjunct Professor in the Department of Development Studies, Department of Sociology at Bangladesh University of Professionals; Dhaka University; and Bangladesh Institute of Governance and Management. His areas of interest are sustainable development; natural resource management; combating climate change; biodiversity conservation; natural disaster management; dams and development; development-induced displacement; development disaster: faulty projects; environmental laws and enforcement etc. He is a prolific writer and extensively contributed book chapters in edited books published by Springer-Nature, Routledge and Palgrave Macmillan.