অর্থনীতি বা সমাজ বিজ্ঞানের পড়য়া বিদ্যায় শিক্ষিত না হওয়ার কারণেই সম্ভবত আমাদের দেশের অর্থনীতিক ও সামাজিক উন্নয়নের সূচক সম্মহের ওঠা নামার ব্যাপারটা কোনও দিনই আমার কাছে খোলাসা হলো না। অর্থনীতি ও সামাজিক সূচকের কেবল উন্নতিই লক্ষ করে চলেছি বেশ কিছু দিন ধরে। এর কমার কোনো লক্ষণও দেখছি না আর সেটা কাম্যও নয়। তবে এত যে উনতি, তা যাচ্ছে কোথায় – সেটাই আমি ভেবে পাই না। অবশ্য আমার এ ভেবে না পাওয়াটা কারো কোনো মাথা ব্যথার কারণ হওয়ার কথা নয় আর উচিতও নয় – আমার মতন একজন অর্বাচীনের জন্য তো এটাই স্বাভাবিক।
তবে সূচক যেহেতু বাড়ছে, ধরুন আগে যেখানে ছিল চার এখন সেটা বেড়ে হয়েছে আট বা দশ – তা হলে তো নির্ঘাত আমাদের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন ঘটেছে। সচকের প্রভাবে নিশ্চয়ই আমদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অনেক উন্নয়ন ঘটেছে, উন্নতি হয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থার, জনগণের চলাচলের, বিদ্যুতের প্রাপ্যতা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও আর যা যা হতে পারে – তাই নয় কি?
স্বাস্থ্য দিয়েই শুরু করি। বহু দিন আগের কথা বলছি – সূচকের মান যখন সম্ভবত খুবই কম ছিল বা সূচকের হয়তো কোনো বালাই ছিল না। প্রায়ই আমার কানে খুব ব্যথা হতো আর তা হলেই বাবা আমাকে নিয়ে যেতেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আউটডোরে। সেখানে বড় জোর আধা ঘণ্টা অপেক্ষার পর ডাক্তারের সাক্ষাত পেতাম। মাঝে মধ্যে সরকারী ডিসপেনসারি থেকে ঔষধও পেতাম। এ সুযোগ কেবল ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিলনা – ছিল সারা দেশে থানা পর্যায়েও। সূচক বাড়ার সাথে সাথে এই সেবার মান যে কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে তা কেবল ভুক্তভোগীরাই বলতে পারবেন। সুচক বাড়াতে যদিও আমার মত মানুষের পয়সা দিয়ে ডাক্তার দেখানোর ক্ষমতা অবশ্য বেড়েছে – তবে তার চেয়ে অনেক গুণে বেড়েছে আমার বাবার মতন মানুষ যাদের জন্য পয়সা দিয়ে ডাক্তার দেখানো খুবই দুঃসহ।
প্রচণ্ড গরমের দিনে বাবা যখন একটা ফ্যান কিনে আনলেন সেদিন আমাদের কি আনন্দ। সেটার নিচে পুরা পরিবার মিলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে কাটিয়ে দিয়েছি গরমের সময় আর রাত্রি কেটেছে পরম প্রশান্তিতে। এখন সূচকের উন্নতির বদৌলতে আমার বাড়ির প্রতিটি কক্ষেই লাগানো রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রক – তার পরও দিন ও রাত্রির বেশির ভাগ সময়ই কাটে ঘর্ম-সিক্ত অবস্থায় । তবে যারা সূচক উন্নয়নের কর্ণধার তারা এটা মানতে একেবারেই রাজি নন। তারা যে জানতেই পারেন না কখন বিদ্যুৎ যায় আর কখন আসে!
সেই কবে বাবার হাত ধরে বছরের প্রথম দিনে স্কুলে ভর্তির জন্য গিয়েছিলাম তার স্মতি কিছুটা আবছা হলেও মন থেকে একেবারে মুছে যায় নাই। যত টুকু মনে করতে পারি বাবাকে দেখে মনে হয় নাই যে তিনি কোনো দিপ্বিজয় করে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন। তবে আমি যখন আমার দুই কন্যাকে পছন্দ মত স্কুলে ভর্তি করতে পেরেছিলাম তখন আমার নিশ্চিত মনে হয়েছিল যে অসাধ্য সাধন করতে সমর্থ হয়েছি। এ ব্যাপারে আরো একটা তফাত ছিল বাবার সাথে আমার। বাবা যে পরিমাণ ভর্তি ফী দিয়েছিলেন তা ছিল একজন নিম্ন বেতনভূক সরকারী কর্মচারীর এক মাসের বেতনের তিরিশ ভাগের এক ভাগেরও কম আর আমাকে গুণতে হয়েছে তদানীন্তন একজন উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারীর অন্তত এক মাসের বেতনেরও বেশি পরিমাণ অর্থ।
আর উচ্চ শিক্ষার মানের কথা নাই বললাম। শিক্ষা, শিক্ষক ও আনুষঙ্গিক পরিবেশের মান যে সচকের মানের সাথে পাল্লা দিয়ে এতটা বিপরীত দিকে যেতে পারে সেটা বাংলাদেশে না গেলে একেবারেই বোঝা সম্ভব নয়। ছাত্রাবস্থায় দেখেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশী ছাত্রদের জন্য নির্মিত ছাত্রাবাসে পার্শ্ববর্তী দেশসমূহ থেকে ছাত্রদের আনাগোনা। দেখেছি পলিটেকনিক ও মেডিকেল কলেজগুলিতে ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ব্রুনাই, মালদ্বীপ ও অন্য অন্য দেশের ছাত্রদের। সূচক বাড়ার সাথে সাথে ওরাও হারিয়ে গেলো আর আমাদের ছেলে মেয়েরা ঝড় বৃষ্টি রোদ মাথায় করে দিনের পর দিন ওই সব দেশের দূতাবাস গুলির সামনে দাড়িয়ে পড়ল।
সূত্র মতে বাংলাদেশের শিক্ষিত তরুণ তরুণীদের মধ্যে মাত্র ৫% বেকার যা কিনা অনেক উন্নত দেশ থেকেও উন্নততর। নিশ্চয়ই এখন আর আমাদের শিক্ষিত যুবক যুবতিরা সহায় সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়ে জীবন বাজি রেখে মালয়েশিয়া, কোরিয়া বা এই ধরনের কোনো দেশের দিকে পা বাড়ায় না। আর অস্ট্রেলিয়ার মত দেশ যাদের বেকারত্বের দশা আমাদের থেকেও করুণ তারা নিশ্চয়ই আমাদের দূতাবাসগুলির সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে বাংলাদেশের একটা ভিসার আশায়!
এবার আসা যাক রাস্তাঘাটে চলাচলের কথায়। যখন কলেজে পড়ি মা প্রতিদিন আট আনা করে পয়সা দিতেন চার আনা যাওয়ার বাস ভাড়া চার আনা আসার । বাসে উঠলে, তেজগাঁও থেকে নিউ মার্কেট- সময় লাগত বড় জোর বিশ মিনিট। সূচকের কল্যাণে এখন আর আমাকে বাসে উঠতে হয় না – এখন আমার নিজেরই একটা গাড়ি হয়েছে। তবে সেটা করে এখন বনানী থেকে মতিঝিল যেতে লাগে সময় বিশেষে দুই থেকে পাঁচ ঘণ্টা। আর ধরুন রাস্তা পারাপারের সময় ভাগ্যক্রমে যদি কোনো বাস বা ট্রাক ড্রাইভারের নেক নজরে পড়ে জান তাহলে আর ইহকালে হয়তো বাড়ি ফিরতে নাও হতে পারে।
যখন যে দল আমাদের শাসন করেন আর যারা তাদের বিরোধিতা করেন উভয়ে মিলেই যখন জনগণের স্বার্থে অবরোধ বা হরতাল দিয়ে খেটে খাওয়া মানুষের মুখের অন্ন কেরে নেন তখন তাদের বাহাবা দেয়ার লোকের অভাব হয় না। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও জান মালের নিরাপত্তা বিধান যে জীবন মান উন্নয়নের পূর্বশর্ত হতে পারে সেটা সচক উন্নয়নের জারি গান গায়করা একেবারে আমলেই নেন না।
উন্নয়নের সচক বাড়ার পাশাপাশি তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আমাদের দুর্নীতির সূচকও। “অন্যান্য জাতিকে হারিয়ে দিয়ে জীবনের কোনো কোনো ক্ষেত্রে সে হতে শুরু করে প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয়। বিশ্ব-সভায় স্থান করা নিয়ে তার শুরু দুর্নীতি দিয়ে। তৃতীয়, চতুর্থ বা পঞ্চম নয়, এক্কেবারে ফার্স্ট। দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মাধ্যমে আমাদের নাম ফাটে। একবার নয়, বারবার” (সৈয়দ আবুল মকসুদ: প্রথম আলো, জানুয়ারি ০৬, ২০১৫)।
এত সব দেখে ও ভেবে ভেবে আমার নির্বুদ্ধিতা নিয়ে আরো শঙ্কিত হয়ে পড়েছি। সচকের ওঠানামার গোলক ধাঁধার মাঝে পডে বুঝতেই পারি না যে এর ওঠাটা আমাদের জন্যে মঙ্গল জনক না নামাটা। ১৪ ই ডিসেম্বরের প্রথম আলোতে প্রকাশিত জনাব আকবর আলি খানের এক সাক্ষাতকার পডে কিছুটা আশ্বস্ত হলাম যে আমার এই গোলক ধাঁধাটা একেবারেই অমলক নয়। শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ ও মুক্তি সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী জনাব খান ২০০৬ সালের অক্টোবরের শেষে গঠিত সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণের পর ডিসেম্বর মাসে পদত্যাগ করেন। তার আগে ১৯৯৫ থেকে ২০০১ সালের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের অর্থ-সচিব ছিলেন। তার সেই সাক্ষাতকারের অংশ বিশেষ দিয়েই এই লেখার ইতি টানছি।
“বাংলাদেশের অর্জন অনেক। ১৯৭১ সালে যা প্রত্যাশা করেছিলাম, তার চেয়ে অনেক বেশি আমরা করতে পেরেছি। কিন্তু এত সব পাওয়ার পরও দেখা যাচ্ছে, এখনো অনেক অপূর্ণতা রয়েছে। আমরা মাথাপিছু আয় তিন গুণের মতো বাড়িয়েছি, খাদ্য উৎপাদন সাড়ে তিন গুণের মতো করেছি, গড় আয়ুর প্রত্যাশা অনেক বাড়িয়েছি, শিক্ষার হারেও সফলতা অর্জন করেছি, শিশুমত্যুর হারে সাফল্য এনেছি। এভাবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে আমাদের অর্জন রয়েছে। তবু মনে রাখতে হবে, এই অর্জন ভঙ্গুর। যেমন বলা হয়ে থাকে, জাতীয় দারিদ্রা-সূচকের আলোকে বাংলাদেশের দারিদ্রসীমা ছিল ৭০ শতাংশ। সেটা কমে ২৫ শতাংশের নিচে নেমেছে। বক্তব্য সঠিক, কিন্তু বুঝতে হবে যে, এ হিসাব করা হয়েছে জাতীয় সচকের ভিত্তিতে। আন্তর্জাতিক দারিদ্রসীমার হিসাব দেখলে, অর্থাৎ দৈনিক ২ ডলার পিপিপি মাথাপিছু আয়ের নিরিখে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার এখনো ৮০ শতাংশের বেশি।”
“আমরা যখন আনন্দ প্রকাশ করি যে জাতীয় দারিদ্রসীমা জাতীয় আয়ের ভিত্তিতে কমেছে, তখন আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, আন্তর্জাতিক সূচকে আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে। আমাদের জাতীয় আয়ের সচকে বাড়িভাড়া ও স্বাস্থ্য খরচ ধরা হয়নি। বর্তমান দুনিয়ায় এই দুটি উপাদান দারিদ্র্য নিরূপণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে বস্তিতে লোকের সংখ্যা বেড়ে গেছে, কিন্তু মানুষ না খেয়ে নেই। খেতে পাওয়া ছাড়া আরও যেসব জরুরি শর্ত আছে, সেগুলোর নিরিখে আমাদের আরও অনেক কিছু করার রয়েছে। সামগ্রিকভাবে আমরা একদিকে উৎফুল্ল হতে পারি, অন্যদিকে ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তারও কারণ রয়েছে।”
Written in 2015, the subject matter may still be relevant.
Mostafa Abdullah migrated to Australia in the 1970s. He is one of first-generation IT professionals of Bangladesh and retired as the Chief of Party (COP) of USAID Project for establishment of Bangladesh Energy Regulatory Commission. He remains active within the diaspora community in his retirement, collecting stories of the early settlers and their children growing up in the cross-roads of Bangladeshi and Australian culture.