১৯৭১-কেনো যেনো যুদ্ধে গেছি !

0
60

১. যতটা না দেশ প্রেমের টানে, তারচেয়ে বেশি এক অদ্ভূত রোমাঞ্চের টানে আমি যুদ্ধে গেছি। ‘দেশপ্রেম’ কী বুঝার বয়স আসেনি তখনো । তখনো… ! দেশের টান কী ! তেজগায়ে লাল দিঘীর শ্যাওলাঘোলা জলে ফুটে থাকা শ্বেত পদ্মেরআকর্ষন ? শীতের বিকেলে আমাকে টানা লালদিঘী পারের ফুটবলের মাঠ ? মাঠের এই টানই কি আমার প্রেম ! দেশ প্রেম ! আমার মা ! ভাই বোন । গাঁয়ের পাশে শুয়ে থাকা মৃত বড়াল, অথবা পতাকা ?

সততই পরম এক রোমাঞ্চের টানে যুদ্ধে গেছি আ আমি। সেই ১৯৭১এর এপ্রিলে । ৩ তারিখে সাভারের ডেইরী ফার্ম ছেড়ে বাসে লঞ্চে রিকসায় এবং পায়ে হেঁটে কুমিল্লা হয়ে পৌঁছে যাই ত্রিপুরার হাতিমারা ক্যাম্পে । ইন-টেক ক্যাম্প । এপ্রিলের ৭ । স্মৃতিগুলো এখন ঝাপসা কিছু । কুমিল্লার এক সুবেদার এ ক্যাম্পে তখন আমাদের উদ্দীপন যোগানদার ।

অতপর ভারতীয় BSF 84 (অথবা 86 Battalion) এ কর্নেল মুখারজির ট্রেনিং ক্যাম্প । পথে এক হল্ডিং ক্যাম্প হয়ে ৩ মাস পর হাতে স্টেন গান, ব্যাগে ৬টা গ্রেনেড, আর ২ কেজি প্লাস্টিক জেলি ! জুলাই মাসের এক রাতের আঁধারে ফিরি সাভারে । ডেইরী ফার্মে ।

২. বিশাল ভূখন্ড গেরিলা যুদ্ধের ফ্রন্ট । চোখে ভেসে থাকে চে’ । মাস্টার দা । মনে জাগে অজানা ভয়ের শীহরণ । তিরতির এক বিবশ অনুভূতি। পিঠে ঝুলানো স্টেন বুকে দূর্দান্ত সাহসের পরশ দেয় । এই প্রথম এক বিজাতীয় দুঃসাহস জাগে মনে শরীরে । চারপাশের মানুষদের বড় অসহায় লাগে । হৃদয় নামের এক অস্ত্র তখন স্টেনগানটার সঙ্গী আমার । নির্মলেন্দু গুন তখনো লেখেনি, তার মারাত্বক অস্ত্র রাস্তার মোড়ে দাড়ানো সিপাহীদের কাছে জমা দেয়নি ।

স্টেনগানটা আমাকে নির্জন আশুলিয়ায় কাটামাটির পথ বেয়ে টেনে আনে গভীর রাতের ডেইরী ফার্মে । সাভার ডেইরী ফার্মে । গভীর রাতের নির্জনতা আমাকে সন্ত্রস্ত করেনা ! আশুলিয়ার বিলে নৌকায় বসে স্টেনগান শেখে আমার কাছে যুবকেরা । জিরাবোর দেওয়ান, আবুল । ডেইরী ফার্মের রেনু, সুরাইয়া, কাদের মতিন । ডেইরীর ম্যানেজার সদা অস্থির । ফার্মের সহকর্মীর চেহারায় উদ্বেগাকুল কৌতুহল। ওদের চোখে ভীতিজ শ্রদ্ধা ভাসে । তারই পরশ আমার মগজ ছোঁয় । মনে হতে থাকে, সোসাল রিলেসান্স কীভাবে রোলস আউট অফ এ ব্যারেল অফ এ স্টেনগান ! এবং কতক্ষন ! ভাবা যায়, রাজনীতি কেমন করে বন্দুকের নল বেয়ে গলে গলে পরে। তবু যেন কেন অস্থির । যেহেতু, তখন হৃদয়ের মত একটা অস্ত্র অস্ত্রহীনের সঙ্গীন । আমার ।

অদূরপ্রসারী হয় মেশিনগান-গলা ২৭তম পান্জাব রেজিমেন্টের রাজনীতি । হেভি মেশিনগান-গলা রাজনীতি । ২৫ মার্চের রাত ফুরালেই নর্থ-ওয়েস্ট ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস্ এসে দাড়ায় হৃদয়ের মত এক মারাত্বক অস্ত্রের মুখোমুখি । ১৬ ডিসেম্বর আসতেই রাজনীতির মেশিনগান গলে যায় ! ১৬ দিনের মাস হয়ে যায় ডিসেম্বর, ১৯৭১ এ ! ইতিহাসের পাতায় । হৃদয়ের ইতিহাসে স্বল্পতম দৈর্ঘের মাস ।

৩. ডিসেম্বর ১৪ । বেলা দ্বিপ্রহর । ওপাশের ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস্ এর গুলিতে টিটো লুটিয়ে পরে জিরাবো/নিশ্চিন্তপুরের মাঠে ! আমাদেরকে পেছনে রেখে ও এগিয়েছিলো হামাগুড়ি দিয়ে ঝুপ ঝাড়ের ফাঁকে রেকী করতে । একটা আর্তচিৎকার ভেসে আসে . . . ।

– “বাচ্চু ভাই, আমার শরীরে গুলি . . . .”

এর মাঝেই আমাদের সঙ্গে যোগ দেওয়া EPR এর সুবেদারের হাতের এলএমজিটা ডাঃ ডাঃ ঢাঃ ঢাঃ গর্জনে ওপাশের এক পাঠান সেনা ইয়াসিন খানের পেট ফুঁড়ে দেয় । আমরা ওঁত পেতে থাকি । রোদ পশ্চিম আকাশে হেলে গেলে পাঠান সেনারা পূব দিকে সরে গিয়ে আশুলিয়ার শুকনো বিলে নেমে যায়। মিরপুরের দিকে। ততদিনে বিল আশুলিয়ার পানি নেমে গেছে তুরাগে। বুলেটাহত পাঠান ইয়াসিন খানকে জিরাবোর মাঠে ফেলে রাখা হয়। ডেইরী ফার্ম থেকে একটা ল্যান্ড রোভার নিয়ে আসি আমি আর রিয়াজ ড্রাইভার । আমরা টিটোর মৃতপ্রায় শরীরটা তুলে আনি। ডেইরী ফার্মের দিকে চলছে জীপ। ল্যান্ড রোভারে শুয়ে থাকা টিটো প্রশ্ন করে কাতর কণ্ঠে :

– “দেশ কি স্বাধীন হয়েছে, মতিভাই ?”

মৃত্যুর গহ্বরে দাড়িয়ে এ এক হৃদয় অবশ করা প্রশ্ন । আমি আর্ত চিৎকার করে উঠি:

– ” হ্যাঁ, টিটো, হ্যাঁ” ।

বাচ্চু Groupএর গোলাম দাস্তগীর টিটো এখোন শুয়ে আছে ডেইরী ফার্মের ভেতর। গেটের পাশে লাল ইঁটের ফ্রেমে। আমি অতপর স্বাধীন দেশের নিশান উড়াই জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার লাইব্রেরীর ছাদের উপরে । ডিসেম্বর ১৭ । পাশে দাড়িয়ে জাহাঙ্গিরনগরের জন সাতেক অধ্যাপক, ১০/১২জন কর্মচারী।

৪. যুদ্ধ থেকে ফিরে দেখি হেলাল হাফিজ লিখেছে, “এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার সময় তার”।আমি যখন যুদ্ধে গেছি তখন আমার বয়স ২৫। আমি যখন জাবিতে ছাত্র তখন আমার বয়স ২৫। আমি যখন জাবির শিক্ষক বয়স আমার তখন ২৫। PhD করি যখন তখন আমার বয়স ২৫। U of M এ যখন Assistant Professor আমার বয়স তখন ২৫। এবছর ২০১৭তে আমি আমার সেই ২৫ বছর বয়সটা ধরে রেখেই ঢাকায় ফিরেছিলাম !

১৯৭১এর ৯ মাস যুদ্ধক্ষেত্রে আমি স্বয়ং আশুলিয়া পাথালিয়ার পিপুলের “অসহায়ত্ব”এর কারণ ছিলাম। আমার কাঁধের ৯ মিমি কার্বাইনটা অযাচিত ভীতির কারণ ছিল এই এলাকার সাধারণ জনতার। আজ অনেক বছর পর ঢাকায় ফিরে দেখি আমি স্বয়ং সারাদেশের “অসহায়” জনতার কাতারে দাড়িয়ে আছি। কারা যেনো আমার অস্ত্রটা কোন ফাঁকে হাতিয়ে নিয়েছে। কেমন করে যে আমি অস্ত্রহীন হয়ে “অসহায়”এর দলে ভীড়ে গেছি, টেরতো পেলাম না।

৫. মাঝে সাজে এখোন ঢাকা এয়ারপোর্টের রাস্তায় বোম ফুটছে। সিলেট হবিগঞ্জ কুমিল্লা থেকে বোমার আস্তানার সংবাদ আসছে। “অসহায়” জনতার কাতারে আমি এখন সেই মতি রহমান, ফেসবুকারদের ভাষায় “সাভার ডেইরী ফার্মের তৃতীয় শ্রেনীর Lab Assistant, “মহান” মুক্তিযোদ্ধা, সেলুট, সালাম মতিভাই আপনাকে।

আশুলিয়ার বিলে, নৌকায় যুবকদের ট্রেনিংএ, বা ১৯৭১, ১৩ আগস্ট গভীর রাতে সাভারের ঢাকা বেতার Transmission Stationএ আক্রমনে ব্যস্ত . আমি তখন; যখন আমি Dairy Farmএর Lab Assistant, আমি তখন জাবিভূ’ দ্বিতীয় বর্ষ, আমি তখন Ph.Dর ছাত্র, আমি তখন Research Project Director, U of Manitobaর Assistant Professor.

(বাচচু* = নাসির উদ্দিন বাচ্চু “ঢাকা থিয়েটার”এর প্রতিষ্ঠাতা।)

Moti_Rahman
motirahman@shaw.ca | + posts

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here