বৈরুত নিয়ে সব সময়ই আমার মনে কৌত‚হল ও উত্তেজনার সাথে সাথে একটা শঙ্কা এবং ভীতি কাজ করত। এ বার সফরের সময় যত ঘনিয়ে আসতে লাগল, উত্তেজনা যেমন তেমনই রইল, কিন্তুভীতি যেন আস্তে আস্তে ঘনীভূত হতে থাকল। সফরসূচি চ‚ড়ান্ত করার সপ্তাহ খানেকের মধ্যে ‘ফ্লাই দুবাই’-এর একটা ফ্লাইট রাশিয়াতে গিয়ে ক্র্যাশ করল। বাষট্টি জন যাত্রীর মধ্যে কেউই বাঁচল না। শুনেই মনটা কেন জানি ছ্যাঁৎ করে উঠল, ক’দিন পর তো আমাকেও উড়তে হবে ‘ফ্লাই দুবাই’-এ! দুর্ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে, একদিন রেডিওতে শুনলাম, বৈরুতে এক অষ্ট্রেলীয় শিশুকে অপহরণ করা হয়েছে। বুঝতেই পারছেন, আমার মনের অবস্থাটা কেমন। যাব কি যাব না, ভাবতে শুরু করেছি, কিন্তু আমার ছেলে ও তার মাকে কিছু বলিনি। আমি জানি, ঘরে এ সব আলোচনা হলে এবারও আমার বৈরুত যাওয়া মাঠে মারা যাবে। বড় মেয়ে তো আমার সফরের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েই রেখেছে।
এমন দোলাচলের মধ্যেই আল্লাহ্র ওপর ভরসা করে মন শক্ত করলাম এবং এপ্রিলের ১৫ তারিখ যথারীতি দুবাইবৈরুতের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। দুবাইয়ের কাজ সেরে ঊনিশ তারিখ এয়ারপোর্ট গিয়ে যখন বৈরুতগামী মিড্ল ইস্ট এয়ারলাইন্সের (এটা লেবাননের ন্যাশন্যাল ফ্ল্যাগ ক্যারিয়ার) বিমানে উঠলাম, তখন ফ্লাইট এটেন্ডেন্টদের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হলাম এবং ভাবলাম, এমন ভালো মানুষরা যে শহরে থাকে, সে শহর মানুষের জন্য কী করে অনিরাপদ হয়? আপাত স্বস্তির সাথে বসলাম। বিমান আকাশে ডানা মেলার সাথে সাথে জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম দুবাই-উপকূলের কৃত্রিম দ্বীপে বানানো হোটেল ‘আটলান্টিস’ ও ‘পামজুমায়রা’। ওপর থেকে অপরূপ লাগছিল! তারপর শুরু হলো বালুর সাগর পার হওয়ার পালা। ঘন্টা দু’এক পরে গরম ভাপ ওঠা সুস্বাদু খাবারের গন্ধ ক্যাবিনের বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল। এমন খুশ্বুতে খিদে না লাগলেও খেতে ইচ্ছে করে। খাবার আয়োজন চলছে। এক ফøাইট এটেন্ডেন্ট আমাকে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘চিকেন অর ফিশ?’ প্রশ্ন করলাম, হোয়াট কাইন্ড অফ ফিশ? ‘হামুর,হাসিমুখে বললেন তিনি। সাধারণত সফরে আমি মাছ খাই না, কিন্তু কী মনে করে তখন বলে ফেললাম, লেট মি ট্রাই ফিশ। খেয়ে ভালোই লাগল। ‘হামুর’ অত্যন্ত সুস্বাদুএকটি সামুদ্রিক মাছ। আপনারাও কোনো দিন সুযোগ পেলে খেয়ে দেখবেন।
এর মধ্যে গাড়ি ভ‚মধ্যসাগরের পাড় ধরে চলতে শুরু করেছে। রাস্তার দু’ধারে সারি সারি পাম গাছ। কিন্তু বড় করুণ তাদের চাহনি! সবক’টা গাছের ডাল ও পাতা আধমরা, শুকিয়ে বাদামি রঙ ধরেছে, নিচের দিকে সামান্য একটু সবুজের ছোঁয়া আছে মাত্র। ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম, গাছগুলোর অবস্থা এমন কেন? তিনি বললেন, ‘বৃষ্টি হচ্ছে না, তাই।’ সাগর ভরা পানি, অথচ পানিরই অভাবে পানিসংলগ্ন সাগরতীরের গাছগুলো সব মৃত্যুর সাথে লড়ছে। হলে কী হবে, মনে হলো, তবু তারা মানুষের মতো অকৃতজ্ঞ নয়! আধমরা গাছগুলো একাগ্রচিত্তে তাদের প্রভ‚র নাম জপছে আর বৃষ্টির অপেক্ষায় দিন গুনছে।
এভাবে ঘুরেফিরে একসময় গাড়ি এসে থামল হোটেল কমোডোরের সামনে। আপত ভয়ের অবসান হলো। জিনিসপত্র টেনে নিয়ে হোটেলে উঠলাম। বিকেলে খেতে যখন নিচে নামলাম, তখন ফের ভীতি এসে আমাকে তাড়া করতে লাগল। লবিতে দেখলাম লোকজন আছে, কথাবার্তাও বলছে, কিন্তু কেন যেন একটা থমথমে ভাব বিরাজ করছে। তার ওপর আরেকটা বিষয় নজর কাড়ল। যখন চেক-ইন করি তখন ক্লান্তিএবং তাড়াহুড়োর কারণে খেয়াল করিনি, এবার দেখলাম Ñ দেখে একটু ঘাবড়ালামও বটে! পাঁচ তারকা হোটেল, তার সামনের প্রধান রিভলভিং ডোর বন্ধ। ডান দিকের ছোট দরজা দিয়ে লোকজন ঢুকছে এবং বাঁ দিকেরটা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। ডান দিকের দরজার পরেই এয়ারপোর্টের মতো একটি মেট্যাল ডিটেক্টার গেট, যার ভেতর দিয়ে আমি ঘন্টাখানেক আগেই পাস করেছি, কিন্তু টের পাইনি। আরো দেখলাম, ওই সিকিউরিটি দরজার পাশে একটি টেবিলের ওপরে রাখা কালো মেট্যাল ডিটেক্টার ব্যাটন। কাছেই স্যুট পরে দাঁড়িয়ে আছেন একজন সিকিউরিটি গার্ড। ভয়ে ভয়ে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের হোটেলে ইদানীং কি কোন অঘটন ঘটেছে? বলল, ‘না, হোটেলে কিছু হয়নি, তবে শহরে এদিক-ওদিক যখন-তখন বোমাবাজি হয়, তাই আমরা সব সময় সাবধান থাকি।’ হোটেলে এসেও শান্তি নেই! বুঝলাম, বৈরুতের বাকি দিনগুলোও আমাকে এভাবেই কাটাতে হবে।
আপনাদের হয়তো মনে আছে, ঊনিশশো তেষট্টি সালে পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী বৈরুতেরই এক হোটেলে ঘুমের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকে মারা গিয়েছিলেন। আমার বার বার ভয় হচ্ছিল, আমিও যদি এভাবে ঘুমের মধ্যে মরে পড়ে থাকি, তা হলে কী হবে? নিজের অবুঝ মনকে নিজেই বুঝাতে লাগলাম, সোহ্রাওয়ার্দী সাহেব একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, আমি তো তাঁর ব্যাগ বওয়ারও যোগ্য নই। তিনি বৈরুতে এসে মারা গেছেন বলে আমিও মারা যাব – এটা কি কোন যুক্তির কথা হতে পারে? অবশেষে মনের ভয় যুক্তির কাছে না হলেও ক্লান্তির কাছে হার মানল। কখন যে কীভাবে ঘুমের কোলে ঢলে পড়েছিলাম সেটা টেরই পাইনি। সকালে উঠে দেখলাম ওই সব ভয়টয় উবে গেছে। প্রথম রাত যখন পার করে দিয়েছি, তখন এ যাত্রা আর মরব না।
কেমন করে বুঝলাম, এবার শুনুন তার বয়ান। লাঞ্চে যাওয়ার সময় বিভাগীয় প্রধানকে জিজ্ঞেস করলাম, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মুসলমান-খ্রিষ্টান অনুপাত কত? তাঁর পাশ থেকে আরেকজন জবাব দিলেন, ‘আমরা এ পরিসংখ্যান রাখি না।’ এটা শুনে শিক্ষকদের মধ্যে অনুপাত কেমন, তা আমি আর জানতেও চাইনি। লাঞ্চ সেরে এসে বসলাম অন্য এক অধ্যাপকের অফিসে। তাঁর নাম হোসেইন জিটার। ড. জিটারের সাথে কথা হচ্ছিল কাহ্লিল জিবরানকে নিয়ে। দেখলাম তিনি জিবরানের একজন বড় ভক্ত। কথা বলতে বলতে হোসেইন উঠে তাঁর পেছনের দেয়াল থেকে একটা কাঠের ডেকোরেশন পিস নিয়ে এসে আমাকে গিফ্ট করলেন। ওর মধ্যে জিবরানের একটা স্কেচ পোট্রেট-সহ আছে জিবরানেরই লেখা একটি আরবি কবিতা। আমাকে কিছু পড়ে শোনালেন। তিনি আমাকে পরদিন জিবরানের গ্রামের বাড়ি, মিউজিয়াম ও তাঁর সমাধিতে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন। ডেকোরেশন পিসের সাথে তিনি একজোড়া তসবিহ নামালেন। আমি জানতে চাইলাম, আপনি এগুলো দিয়ে কী করেন? তিনি বললেন, ‘সুবহানাল্লাহ্, সুবহানাল্লাহ্ পড়ি।’ এবার আমি নিশ্চিত হলাম, তিনি মুসলমান।
আমি নামাজ পড়তে চাইলাম, তিনি একটা টাওয়েল বিছিয়ে দিলেন। তারপর মন খুলে আমার সাথে বেশ কিছু কথা বললেন, মনের দুঃখ নামাতে পেরে মনটাকে হালকা করলেন। বললেন, এলএইউতে মুসলমান ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা ৭০ শতাংশের মতো। প্রতিষ্ঠানটির সমানুপাতিক আয় আসে মুসলমান অভিভাবকদের কাছ থেকে, অথচ শিক্ষক-কর্মচারিদের মধ্যে ২০ শতাংশ মুসলমানও নেই। যাও বা আছে, তারা পদে পদে দারুণভাবে বৈষম্যের শিকার। সমস্তরিকোয়ারমেন্ট মিট করার পরও আমার প্রমোশন হয়নি। একমাত্র কারণ, আমি মুসলমান। বুঝলাম, প্রশাসন খ্রিষ্টানদের দখলে। সাধ্যমতো তাঁকে সান্ত¡না দেয়ার চেষ্টা করলাম। বললাম, আপনাদের মতো তিক্ত অভিজ্ঞতা আমারও আছে। ‘খরভব রং হড়ঃ ভধরৎ, নঁঃ ংঃরষষ রঃ রং মড়ড়ফ!’ তা না হলে তো মানবের জন্য দড়িকলসি যোগান দেয়াই কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়াত।
আলোচনার এক পর্যায়ে জিবরান সম্পর্কে তাঁর কাছে আমি একটি প্রশ্ন রাখলাম। মুস্তাফা, ইসলামের শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সঃ) এরই আরেক নাম, এ কথা জিবরানের অজানা ছিল না। তারপরও একজন খাঁটি খ্রিষ্টান হয়ে তিনি কেন তাঁর মাস্টার পিস, ‘দি প্রফেট’-এর মূল চরিত্রের নাম আল্-মুস্তাফা দিলেন? হোসেইন বললেন, খ্রিষ্টান হলেও জিবরান আমাদের রাসুল (সঃ) প্রতি ছিলেন খুবই শ্রদ্ধাশীল এবং ঐতিহাসিকভাবে বিবদমান এ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্কউন্নয়নের উদ্দেশ্যে তিনি সচেতনভাবে তাঁর মাস্টার পিসের প্রধান ও মূল চরিত্রের নাম দিয়েছেন ‘আল্-মুস্তাফা।’
তারপর শুরু হলো আমার প্রেজেন্টেশনের পালা। প্রথমটা ছিল শিক্ষকদের জন্য, পরেরটা ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে। আমার সেমিনারে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। একটি বড় অডিটোরিয়াম, প্রায় ভরা ছিল। ছাত্রদের তুলনায় ছাত্রীদের সংখ্যা দেখলাম অনেক বেশি। তারা আমাকে অনেক বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্ন করেছে । আমেরিকার অর্থনীতি ও নির্বাচন বিষয়ে যা যা জানতে চেয়েছে, তাতে মনে হলো তারা দিন-দুনিয়ার খোঁজখবরও রাখে এবং ভালোই রাখে।
দিনব্যাপী অনুষ্ঠানাদি শেষে সবার সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করে এবার ফিরে আসার পালা। বিকেল পাঁচটার সময় দু’জন শিক্ষক আমাকে গাড়িতে করে হোটেলে নামিয়ে দিলেন। যাওয়ার সময় বলে গেলেন, আটটায় এসে ডিনারে নিয়ে যাবেন। ডিনারে কোথায় গেলাম, কী খেলাম, কী আড্ডা মারলাম? তারপর রাতের বৈরুতে পায়ে হেঁটে ও গাড়িতে করে কী কী দেখলাম, কী বুঝলাম, কী ভাবলাম, সে সব নিয়ে আরেকটা পিস লেখার ইচ্ছে আছে। লিখতে পারলে অবশ্যই আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করব। আজকের মতো এখানেই ইতি।
আবু এন এম ওয়াহিদ ১৯৫০এর দশকের প্রথম দিকে মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭০ এর দশকের গোড়ার দিকে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পড়াশোনা করেন। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বছর অর্থনীতির প্রভাষক হিসেবে অধ্যাপনা করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি
মানিটোবা ইউনিভার্সিটি, উইনিপেগ, কানাডা, থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। বর্তমানে, তিনি ন্যাশভিলের টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি এবং অর্থ বিভাগের অধ্যাপক এবং জার্নাল অফ ডেভেলপিং এরিয়াসের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক।