প্রবাসে বাংলা: প্রেক্ষাপট অস্ট্রেলিয়া

0
86

বাংলাদেশ সহ বাঙালী বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠী এখন পৃথিবীর নানা দেশে বিশেষত পশ্চিমা দেশগুলোতে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। জনসংখ্যার দিক বিবেচনা করলে বাংলা এখন পৃথিবীর চতুর্থ বা পঞ্চম বলিত ভাষা। কিন্তু সত্যিকার ভাবে প্রবাসে বিশেষত অস্ট্রেলিয়াতে (যেহেতু আমি দীর্ঘদিন এখানে বসবাস করছি) বাংলা ভাষার বর্তমান ও সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ হাল চিত্র তুলে ধরার জন্য আমার এই লেখা।

পৃথিবীতে আমরাই একমাত্র জাতি যারা নিজেদের মাতৃভাষা প্রতিষ্টার জন্য স্বাধীনতা আন্দোলনেরও বহু বছর আগে জীবন বিসর্জন দিয়েছি। আমাদের এই বিসর্জনকে সন্মান দেখিয়ে আমাদের বিসর্জনের দিনটিকেও আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবষ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আমরা এতে উচ্ছ্বসিত হয়েছি, গর্বিত হয়েছি তার চেয়েও অনেক বেশী! জাতি হিসাবে আমরা অনেক আবেগপ্রবন, কিন্তু সেই আবেগ ফুরিয়ে গেলে আমরা প্রয়োজন ছাড়া সেই অহংকারের দিকে আর ফিরে তাকাই না, মুষ্টিমেয় ব্যতিক্রম ছাড়া!

ভাষা ছাড়া কোন জাতীগোষ্ঠির সংস্কৃতি টিকে থাকতে পারে না, তার স্বকীয়তা ও ঐতিহ্যও না। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কতিপয় অমিতপ্রাণ বাঙালী আজ থেকে ৪২ বছর আগে অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম বাংলা স্কুল চালু করেছিলেন সিডনীর ইস্টলেক এলাকায়। তারপর থেকে একে একে মেলবোর্ন, এডেলেয়ড, পার্থ, ব্রিজবেন ও সিডনীর আরো অনেক এলাকায় স্কুল চালু হয়েছে ও বন্দ হয়েছে। সিডনিতে এযাবৎকালের মধ্যে শুরু হয়েছিল ১০টিরও বেশী স্কুল। এর মধ্যে দু’টি ছিল মাধ্যমিক পর্যায়ে NSW Saturday School of Community Languages (SSCL) এর অধীনে। এসব স্কুল গুলো প্রতিষ্ঠার পিছনে ছিল বাংলাদেশ থেকে স্বপরিবারে অভিবাসীত কিছু ভাষাপ্রেমী উদ্যোমী মানুষের নিরলস পরিশ্রম ও আন্তরিকতা। শুরুর প্রথম বেশ কয়েক বছর স্কুল গুলো খুব স্বরব থাকতো, আমাদের জনগোষ্ঠীর সংখ্যানুপাতে ছাত্রছাত্রীর উপস্থিতি থাকতো উৎসাহ ব্যঞ্জক। এ সব স্কুল গুলোর মধ্যে অনেক গুলোই এখন বন্দ অথবা প্রায় বন্দ হওয়ার পথে। আবার বিভিন্ন শহর ও সাবার্বে নতুন করে কিছু স্কুল সাম্প্রতিক কালে প্রতিষ্ঠিতও হয়েছে।

অস্ট্রেলিয়াতে ভাষা শেখার প্রধানত দুটি প্রাতিষ্ঠানিক স্তর বিদ্যমান, একটি প্রাথমিক স্তর অন্যটি মাধ্যমিক স্তর। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাকে আবার দুভাগে ভাগ করা যায়, কমিউনিটি পরিচালিত স্কুল (শুধু ভাষা শেখানোর জন্য) এবং সরকারী মেইন স্ট্রীম প্রাথমিক স্কুল। প্রাথমিক স্তরের উভয় স্কুলেই গিন্ডার গার্টেন থেকে ৬ষ্ঠ শ্রেনী পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহে প্রতি ছাত্রকে মাত্র দুই ঘন্টা ভাষা শেখানো যায়। উল্লেখ্য, ইংরেজি শেখা এখানে সর্বস্তরেই বাধ্যতামূলক এবং এধরণের কোন সময় গন্ডিতে বাধা নেই। মাধ্যমিক স্তরে ভাষা শিক্ষা শুধুমাত্র সরকারি এবং বেসরকারি মেইন স্ট্রীম স্কুলেই দেওয়া হয়।

যে পর্যায়েই শেখানো হোক না কেন, এখানে  বাংলা শেখার জন্য ছাত্র ও অবিভাবকদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে হয় অনেক। এ কঠিন কাজটি অবৈতনিক ও নিরলসভাবে  করে থাকেন কমিউনিটির কিছু সংখ্যক ভাষা ও সংস্কৃতি প্রেমী! এদের মাধ্যমেই অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন শহরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কমিউনিটি বাংলা স্কুল গুলো, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিভিন্ন মেইন স্ট্রীম স্কুলে ছাত্র যোগানোর ব্যবস্থা এবং LOTE (Language other than English) ১০ম থেকে ১২শ শ্রেণিতে বাংলা অন্তর্ভুক্তির প্রচেষ্টা।

সারা অস্ট্রেলিয়ায় বাঙালি জনসংখ্যা এখন প্রায় আনুমানিক ৮০ থেকে ৯০ হাজার। সেই তুলনায় আশাব্যঞ্জক না হলেও, বাংলা শেখানোর কিছুটা সাফল্য এসেছে প্রাথমিক স্তরের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে, উদাহরণ সরূপ সিডনিতে এখন পাঁচটি, মেলবোর্নে পাঁচটি, এডেলেইড, ব্রিজবেন, ক্যানবেরা এবং পার্থ এ কমপক্ষে একটি করে স্কুল চালু রয়েছে। এসব স্কুলের নিয়মিত ছাত্র সংখ্যার উপস্থিতি কমবেশি ১০ থেকে ৬০ এর মধ্যে। পক্ষান্তরে, মাধ্যমিক স্তরের বাংলা শিক্ষা একেবারেই হতাশাজনক, যদিও সম্প্রতি মেলবোর্নে কিছুটা আশার আলো প্রজ্জ্বলিত হয়েছে!

১৯৯৮ সালে আমরা NSW LOTE বাংলা অন্তর্ভুক্তির প্রচেষ্টা শুরু করেছিলাম। তখন ভিক্টোরিয়ার LOTE এ বাংলা অন্তর্ভুক্ত থাকলেও ছাত্র সংখ্যার অপ্রতুলতার কারনে একাদশ বা দ্বাদশ শ্রেণিতে পরীক্ষা নেওয়া স্থগিত ছিল। দুই প্রদেশ মিলে উচ্চ মাধ্যমিকে নূন্যতম ১৫ জন ছাত্র যোগাতে পারলে দুই প্রদেশের LOTE ই বাংলা পরীক্ষা পূনরায় চালু করার শিক্ষা মন্ত্রনালয় কতৃক ওয়াদা পেয়েছিলাম। সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে বাংলা প্রসার কমিটি গঠন এবং তার মাধ্যমে ২০০৬ সালে NSW SSCL এর ডালউইচ হিল সেন্টারে বাংলা কোর্স চালু হয়েছিল। কিন্তু আমরা ৮-৯ বছরে LOTE লেবেলে ১৫ জন আগ্রহী  ছাত্র দেখাতে ব্যর্থ হই! সংখ্যার যোগান কমতে থাকায় পরবর্তীতে, সম্ভবত ২০১৪-১৫ সালে ডালউইচ হিলে বাংলা বন্দ করে লিবারপুল সেন্টারে স্থানান্তর করা হয়। বর্তমানে ছাত্রের অভাবে সেই সেন্টারের কোর্সও স্থগিত হয়ে আছে। তবে, আশার কথা, সম্প্রতি ২০১৯ সালে ভিক্টোরিয়ার LOTE আবার বাংলা চালু হয়েছে। মেলবোর্ন ভিত্তিক একদল বাংলা প্রেমীদের উদ্যোগে এবং  Victoria Curriculum Assessment Authority (VCAA) এর অনুমোদনের মাধ্যমে এটি সম্ভব হয়েছে। মেলবোর্নের Western Region Bangla School (WRBC) এর অধ্যক্ষের কাছ থেকে যতোটা জেনেছি, ২০২২ সালে ২২জন, এবং ২০২৩ সালে ১২ জন সেখানে LOTE এ বাংলা নিয়ে পরীক্ষা দিয়েছিল। এবছর সংখ্যা হয়ত ১২ বা তার চেয়ে কিছু বেশি হতে পারে!

সিডনির প্রাথমিক স্তরের পাঁচটি বাংলা স্কুলের মধ্যে তিনটি সরকারি মেইন স্ট্রীম স্কুল এবং দুইটি কমিউনিটি স্কুল। মেইন স্ট্রীম স্কুলে বাংলার ছাত্র সংখ্যা প্রতি স্কুলে মোটামুটি ৫০ থেকে ৬০ এর মধ্যে আর কমিউনিটি স্কুল গুলোতে ৩০-৫০ এর মধ্যে উঠানামা করে। সিডনির ক্যাম্পবেলটাউন বাংলা স্কুল দুইটি স্কুলের মধ্যে অন্যতম এবং ২০০১ সাল থেকে অদ্যাবধি চলে আসছে, তবে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা শুরুকালীন সময়ের চেয়ে কম। এর বাইরেও হয়তো আরো দুই একটি কমিউনিটি পরিচালিত স্কুল থেকে থাকতে পারে, তবে কার্যক্রম চোখে পড়ার মত নয়।

অস্ট্রেলিয়াতে বাংলা শিক্ষা কার্যক্রম বা স্কুল প্রতিষ্ঠা যাই বলা হোক না কেন, করাটা অনেক সহজ, তবে ধরে রাখা বেশ কঠিনতর কাজ। প্রথমতঃ এখানে বাংলা শেখাতে হলে উদ্যোগতাদের চলতে হয় অনেকটা অস্ট্রেলিয়ান স্বাভাবিক জীবনযাত্রার বিপরীতে। যেমন সপ্তাহন্তে ছেলেমেয়েদের কোচিংএ নিয়ে যাওয়া, খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করানো, বাজারঘাট করা উপরন্তু বিশ্রাম নেওয়া ইত্যাদি  অধিকাংশ পরিবারেরই অগ্রাধিকারের বিষয়। সেই ক্ষেত্রে বাংলার জন্য গভীর আন্তরিকতা ও ডেডিকেশন না থাকলে কেউ তাদের ছেলে মেয়েদের বাংলা শেখাতে নিয়ে আসে না!

দ্বিতীয়তঃ আয়োজক বা উদ্যোগতা টিম নবায়নে নতুন সদস্যদের এগিয়ে আসার অনাগ্রহ। একই ব্যাক্তিবর্গকে দীর্ঘদিন ধরে রাখতে হয়। যেহেতু এটি একটি অবৈতনিক কাজ এবং নিয়মিত সাপ্তাহিক সময়ের প্রতিজ্ঞা রাখতে হয়, সেহেতু খুব মানুষই এখানে সেবা প্রদানের আগ্রহ প্রকাশ করেন! তৃতীয়তঃ যোগ্য, অভিগ্ঞ ও  আগ্রহী শিক্ষকের অভাব। এখানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষাদানের জন্য শুধুমাত্র অভিজ্ঞতাই যথেষ্ট নয়। তার জন্য নির্দিষ্ট কিছু সনদ অর্জন করতে হয় এবং শিক্ষা বিভাগে আবেদন করার প্রয়োজন হয়। এধরনের যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ যে আমাদের কমিউনিটিতে নেই তা নয়, কিন্তু তাঁরা তাদের পেশা বা কাজে অন্যত্র ব্যস্ত থাকেন বিধায় বাংলা শিক্ষার সাথে যুক্ত হতে চান না! চতুর্থতঃ প্রবাসী অনেকেই মনে করেন, প্রবাসে বাংলা শিক্ষার কোন প্রয়োজন নেই, শুধুমাত্র ভালোভাবে ইংরেজি জানলেই হবে! তাদের এই ধারনা সম্পুর্ন ভূল! শিশু-কিশোর বয়সে নিজস্ব ethnic ভাষায় দখল ছাত্রছাত্রীদের তাদের অতীত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে আবদ্ধ রাখার পাশাপাশি ইংরেজি ও অন্যান্য শিক্ষাকেও (Numeracy & literacy) তরান্বিত করে।

বাংলা শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে হলে প্রবাসী সকল স্তরের বাঙালিদেরকে ঐক্যবদ্ধ এগিয়ে আসতে হবে। অবিভাবক, যোগ্য শিক্ষক, মিডিয়া কর্মী, সংস্কৃতি কর্মী সহ সকল বাংলা ভাষাভাষী প্রবাসীবৃন্দ ঐক্যবদ্ধভাবে চেষ্টা চালালেই একমাত্র এটি সম্ভব! আশাকরি, হাজার বছরের বাংলা, বাঙালির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের সার্থে সকল প্রবাসী সম্মিলিত ভাবে এই প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন!

আব্দুল_জলিল
আব্দুল জলিল
jalil2712@gmail.com | + posts

আব্দুল জলিল

সাবেক সভাপতি বাংলা প্রসার কমিটি অস্ট্রেলিয়া (২০০৪-২০১২)।

উদ্যোগতা, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও সাবেক সভাপতি ক্যাম্পবেলটাউন বাংলা স্কুল, সিডনি।

প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ইনার ওয়েস্ট বাংলা স্কুল এ্যাশফিল্ড, সিডনি (১৯৯৬-১৯৯৯) (বর্তমানে বন্ধ)।

সাবেক সহকারী অধ্যাপক হাজী মোহাম্মদ দানেশ কৃষি কলেজ (বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়) দিনাজপুর বাংলাদেশ। E-mail: jalil2712@gmail.com

Previous articlePreserving Bangla language and culture in Singapore
Next articleCrises and potentials of nation building in Bangladesh
আব্দুল জলিল সাবেক সভাপতি বাংলা প্রসার কমিটি অস্ট্রেলিয়া (২০০৪-২০১২)। উদ্যোগতা, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও সাবেক সভাপতি ক্যাম্পবেলটাউন বাংলা স্কুল, সিডনি। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ইনার ওয়েস্ট বাংলা স্কুল এ্যাশফিল্ড, সিডনি (১৯৯৬-১৯৯৯) (বর্তমানে বন্ধ)। সাবেক সহকারী অধ্যাপক হাজী মোহাম্মদ দানেশ কৃষি কলেজ (বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়) দিনাজপুর বাংলাদেশ। E-mail: jalil2712@gmail.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here