Over 11.35 lakh (1.4 million) Bangladeshis (কানা ফারুক ) migrated to foreign nations in 2022, the highest ever in the history of Bangladesh.
কানা ফারুক (Blind Faruk) symbolizes Bangladeshi migrant workers who often fall victims of human traffickers and take dangerous journeys. Ishtiaq Mannan narrates their heart-touching stories as travels to different countries as a public health expert.
তখন লালমাটিয়ায় থাকি। আট এপার্টমেন্টের ছোটোখাটো কমিউনিটি। সুখী, শান্ত ও মধ্যবিত্ত। জনা চারেক অবসরপ্রাপ্ত চাচা-চাচী সেই আট পরিবারের অংশ। সারাজীবনের সঞ্চয়ের বিরাট অংশ খরচ করে তাঁরা এই এপার্টমেন্ট কিনেছেন – প্রতিটা পয়সা বুঝে শুনে খরচ করতে চান। লিফট কেনো চলবে, জেনারেটর কেনো লাগবে, ক্লিনার একজন হলেই তো চলে, ময়লা কালেকশনের পয়সা দিতে হবে কেনো, নিজেরা ফেলে দিয়ে আসলেই তো হয়, ম্যানেজার লাগবে কেন আমরা চারজন তো বসেই থাকি, পালা করে আমরাই নাহয় বিল দিয়ে আসবো – প্রতি মিটিংয়ে এই ধরণের ‘অনাধুনিক’ প্রশ্ন করেন তাঁরা। আমরা অপেক্ষাকৃত তরুণ পরিবারেরা মহা বিরক্ত। আমাদের মনোভাব হচ্ছে, ফেলো কড়ি মাখো তেল, এতো চিপাচিপির কি দরকার ! কাঁচা পয়সার প্রভাব !
এই ক্রমাগত কৃচ্ছসাধনের ধারাবাহিকতায়, একদিন সিকিউরিটি কোম্পানির সাথে চুক্তি বাতিল করা হলো। তাঁর বদলে, কোনো একজন এপার্টমেন্ট মালিকের গ্রামের বাড়ী থেকে এসে উঠলো দুজন মানুষ। পালা করে পাহারা দেওয়া, পোশাক পরা যে গার্ডরা আসতো এতদিন তাদের জায়গা নিলো সত্তোরোর্ধ বৃদ্ধ রহিম মিয়া আর তার বাইশ তেইশ বছরের ছেলে ফারুক। ফারুক বয়সে বড়ো, গায়ে গতরে নাদুস নুদুস – তার এক চোখ নষ্ট। সে বোকা কিসিমের, মুখে কোনো এক্সপ্রেশন নাই, হাসে না, কথা প্রায় বলেই না। গ্রামের ভাষায় ভ্যান্দা প্রকৃতির। আড়ালে তার নাম হলো, কানা ফারুক।
আমাদের ছোট এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে গার্ডদের থাকার জায়গা নাই। তাই এই দুই সদস্যের পুরুষ পরিবারের জায়গা হলো পার্কিং এরিয়ার পেছনদিকে একটা খালি পার্কিং লটে। মানে, কোনো এক মালিকের গাড়ী নেই, সেই জায়গায়। আমাদের বিরক্তির সীমা চরমে তুলে সেখানে বসলো ভাঙা হতশ্রী চকি, আসলো চুলা, জেনারেটর রুমের দেয়ালে পেরেক গাঁথা হলো কয়েক জোড়া। পেরেকে পেরেকে বাঁধা হলো দড়ি। দড়িতে ঝুললো, জামা-লুঙ্গি-ময়লা গেঞ্জি। চকির নিচ থেকে উঁকি দিলো তেল চিটচিটে কড়াই আর ডানোর টিন।
যেতে আসতে নিত্যদিনের দৃশ্য হলো, হয় রহিম মিয়া বেগুন কাটছে আর কানা ফারুক লুঙ্গি পরে খালি গায়ে চিৎ হয়ে ঘুমাচ্ছে, অথবা রহিম মিয়া গেটে ডিউটি করছে আর কানা ফারুক পিঁড়িতে বসে সপ সপ শব্দ করে ভাত খাচ্ছে। কিংবা, রহিম মিয়া গ্রিল পরিষ্কার করছে, পানির পাম্প ছাড়ছে, মিটার রিডারদের দরজা খুলে দিচ্ছে – আর কানা ফারুক বসে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে – এক চোখেই। অবশ্যই খালি গায়ে। দুজনের একজনও লেখাপড়া জানে না, ভিজিটর খাতা দেয়া হয়েছে – লিখতে পারে না, ভিজিটরদের অনুরোধ করে লিখে দেবার জন্য। আমাদের বিরক্তির, বিতৃষ্ণার শেষ নাই। চাচা সমিতির প্রবল প্রতাপে কিছু বলা যায় না। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করি।
বাপ-ব্যাটা হলেও, চুক্তি অনুযায়ী (যে চুক্তি কেউ দেখে নাই) দুজনের স্ট্যাটাসই ‘গার্ড’। কিন্তু কানা ফারুককে কদাচিৎ কোনো কাজে দেখা যায় – সব কাজ রহিম মিয়াই করে। আমাদের করুনা হয়, এ কেমন কথা। এই বৃদ্ধ খেটেই যাচ্ছে, খেটেই যাচ্ছে – আর জোয়ান ছেলের কোনো মাথা ব্যথা নাই। এদের ভবিষ্যৎ কি আমাদের এখানেই, এই পার্কিং লটেই শেষ হবে ? এই বুদ্ধিহীন, শিক্ষা-দীক্ষাহীন ছেলেটারই বা কি হবে ? এরা কোথাও যায় না, কেউ এদের কাছে আসে না। ঈদের সময়ও তাঁরা আছে।
আমাদের করুনায়, কৃপায়, দেয়ালের সর্বত্র কেরোসিনের চুলার কালি লাগিয়ে এই যুগল বছরের পর বছর পার করে দেয়। রহিম মিয়া এবং কানা ফারুক আমাদের বিল্ডিঙের ইঁট-কাঠ-পাথরের মতোই স্থায়ী হয়ে যায়। বিল্ডিং যতদিন থাকবে ওরাও ততদিন এখানেই, এভাবেই থাকবে এমন। ওদেরকে এখানেই থাকতে হবে অনন্তকাল। ওরা আমাদের কাছে আর স্বতন্ত্র মানুষ থাকে না – পাম্প যেমন, জেনারেটর যেমন, ফেলে দেওয়া টায়ার যেমন – ওরাও তেমনই ‘সাবজেক্ট’ থেকে একসময় ‘অবজেক্ট’ হয়ে যায়।
আমি পাঁচ তলায় থাকি। এক রাতে দশটা-এগারোটার দিকে, দরজায় কলিং বেল। ছিদ্র দিয়ে দেখি রহিম মিয়া দাঁড়িয়ে। কোনো সমস্যা হলো নাকি ? দরজা খুলে দেখি হাতে ছোট একটা বাটি, বাটির ওপর ঢাকনা, ঢাকনার নীচে চারটা মিষ্টি – দুইটা সাদা, দুইটা লাল। আমরা বাসায় চারজন। ভাবলাম অন্য কোনো এপার্টমেন্ট থেকে পাঠিয়েছে। বললাম, কোন বাসা থেকে ? স্যার, ফারুক কাইলকা ওমান যাইতাসে, চাকরি পাইসে, পঁচিশ হাজার টাকা বেতন। দোয়া কইরেন স্যার, ম্যাডামরে কইয়েন দোয়া করতে।
কি? আমি আঁতকে উঠলাম। এ তো নিশ্চই বাটপারের পাল্লায় পড়েছে। কিছুদিন আগেই ভূমধ্যসাগরে নৌকা ডুবে প্রবাস পাড়ি দেওয়া বাংলাদেশী তরুণদের করুন মৃত্যুর কাহিনী পড়েছি, শুনেছি মালয়েশিয়ার জঙ্গলে অবৈধ উপায়ে যাওয়া তরুণদের অত্যাচার করে টাকা আদায়ের কথা। বলেন কি রহিম মিয়া, কিভাবে ব্যবস্থা হলো ? টাকা পেলেন কোথায় ? কত টাকা দিয়েছেন? কোন দালাল? চেনেন ঠিকমতো ? রহিম মিয়া কথা বলে না, আমার উদ্বেগ দেখে হাসে – বিগলিত হাসি। রহিম মিয়ার হাসিতে আমি আশ্বস্ত হই না। হাত কচলে শুধু বলে, স্যার দোআ কইরেন আমার ফারুকের জন্য।
আমি অসম্ভব মন খারাপ করে দরজা বন্ধ করি। স্পষ্ট দেখতে পাই, কোনো এক মরুভূমি থেকে দালালের ফোন এসেছে, রহিম মিয়া আকুল হয়ে কাঁদছে, কিভাবে কানা ফারুকের লাশ দেশে আনবে এইজন্য এই দ্বারে সেই দ্বারে ঘুরছে। আমার বুকে বাজতে থাকে, ‘আমার ফারুক’। আহারে। নিশ্চই সর্বস্ব বিক্রি করে দালাল কে দিয়েছে।
পরের কয়েক দিন, কয়েক মাস উঠতে নামতে আড়চোখে রহিম মিয়ার দিকে তাকাই। চোখাচোখি হতে ভয় পাই। কিন্তু সেই বৃদ্ধ ডিউটি করে যায়। ব্যতয় নাই, চোখমুখ ভাবলেশহীন। হঠাৎই একদিন নিজে থেকে এগিয়ে এলো, বললো, স্যার ফারুকে প্রথম মাসের বেতন পাঠাইসে। থাকা খাওয়া কোম্পানির, ফ্রি। বিশ হাজার টাকা পাঠাইসে। জমি রাখতে কইসে। আমার আশংকার দুঃসংবাদ এলো না কোনোদিন, অন্তত যতদিন রহিম মিয়া ছিলো।
আজও আমি জানিনা – অহর্নিশি আমাদের সেই পার্কিং লটের কোনায় বসে থেকে, শুধু বেগুনের ঝোল আর ভাত খেয়ে, কিভাবে এই দুজন দালাল খুঁজে বের করলো, কি করে টাকা জোগাড় করলো, কিভাবে পাসপোর্ট-টিকিট করলো, কিভাবে চাকুরী জোগাড় করলো – কানা ফারুকের রহস্য, রহস্যই রয়ে গেলো।
কিভাবে সম্ভব হয়েছিলো, এটা রহিম মিয়া আর কানা ফারুকই সবচেয়ে ভালো বলতে পারবে, কিন্তু আসলেই যে সম্ভব সেটা দুনিয়া ঘুরে আমি এখন বুঝতে পারি।
কোনো একটা টেকনিক্যাল কর্মশালায় গেছি ইতালির বেলাজিওতে। ফেরার পথে দুইদিন থাকলাম, রোমে। সাথে অধ্যাপক শহীদুল্লাহ। সেই দুইদিন ইংরেজি বলতে হলো না। যে কোনো মোড় ঘুরতেই কোনো একজন বা একদল কানা ফারুকের সাথে দেখা। সেই দুইদিন মুখরোচক বাংলা খাবার খেলাম প্রতি বেলায়। স্টেশন ঘিরে অনেক বাংলা হোটেল। এক একদিন এক একজন কানা ফারুক জোর করে তাঁদের নিজেদের হোটেলে ধরে নিয়ে খাওয়ালো আমাদেরকে। নিষেধ করলে মুখ বেজার করে।
সুইৎজারল্যান্ডে যাই। শ্যামনিতে যাই, রোপওয়ে তে করে মোঁ ব্লা দেখবো বলে। আমাদের টার্ন আসতে সময় লাগবে। স্বর্গের মতো, ছবির মতো সুইটজারল্যান্ডের প্রকৃতি দেখি। খিদা পায়। শ্যামনির সেই শীত শীত দুপুরে মোঁ ব্লার গোড়ায় শত শত ইউরোপীয় টুরিস্টের ভীড়ে হঠাৎ একজন কানা ফারুক উদয় হয় – তার ক্যাফেতে ভালো স্যান্ডউইচ আছে, আমরা কি খাবো ? দূর থেকে আমাদের দেখে এসেছে নিয়ে যেতে। অনেক দেশ ঘুরে, চার বছর আগে এখানে এসেছে – কাগজ হয়েছে ছমাস আগে। কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হয়েছিল। পড়া শেষ করে নি।
২০১৭ তে আবার গেলাম রোমে। পরিবার নিয়ে। রোদ মাখা সকালে রোমের রাস্তায় হাঁটি। জীবনে যা করি নাই তাই করি – ফুটপাথ থেকে পুঁতির মালা কিনি, কমলা রঙের প্লাস্টিকের চিরুনি কিনি, বাঁশের ওপর কাঁচা হাতে আঁকা কোলোসিয়ামের ছবি কিনি – ফেলে দিবো জানি, তাও কিনি। কারণ, কানা ফারুকরা রোমের ফুটপাথ দখল করে হাসি মুখে ঐগুলি বিক্রি করে। রহিম মিয়ার কথা ভেবে কিনি। একই দৃশ্য মাদ্রিদের স্কয়ারে। একটা রেস্তোঁরায় পায়েয়া খেতে খেতে ফুটপাথ দখল করে রাখা কানা ফারুকদের বাণিজ্য দেখি। কানা ফারুকরা পয়সা পকেটে পুরতে পুরতে হঠাৎ সবাই মিলে দৌড় দেয়, ফুটপাথ খালি হয়ে যায় মুহূর্তে – কানা ফারুক, ভালো ফারুক কেউ নাই। পুলিশের টহল আসে। আমি জানি, কানা ফারুকরা আবার ফিরে আসবে, ওদেরকে ফিরে আসতেই হবে।
জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের কাজে বেইজিং যাই। ডিসেম্বরে শীতের রাত। শূন্যের নীচে তাপমাত্রা। হোটেল থেকে বের হতে হয়, ওষুধ কিনতে। ফেরার সময় শুনি হোটেলের বাইরে প্রায় অন্ধকারে, বিরাট একটা পিলারের আড়াল থেকে কান্নার শব্দ। ফোঁপানোর। আলো আঁধারিতে ওদের পার হয়ে যেতে যেতে দেখি মেয়েটার বাঁ হাতে একটা ছোট সুটকেস, ডান হাতটা পিলার এর ওপর রেখে কনুইয়ের ভাঁজে মাথা গুঁজে আছে। কান খাড়া করে শুনি বাংলা কথা – ময়মনসিংহের টান। একজন যুবক তাঁর সাথের মেয়েটাকে বোঝাচ্ছে বাড়ি ফিরে যেতে, চলো চলো। মেয়েটা কেঁদেই যাচ্ছে, কেঁদেই যাচ্ছে। ছেলেটা যতই বলে আর গায়ে হাত তুলবে না, ততই মেয়েটার কান্না বাড়ে। কানা ফারুকদের সাথে তাদের সুখ দুঃখও সীমানা পাড়ি দেয়।
ইরাকের আরবিলে যাই সেভ দ্য চিলড্রেনের কাজে। প্রায় আটশো এপার্টমেন্টের একটা বিরাট কমপ্লেক্স রোয়া টাওয়ার। ধনী ইরাকিরা এইসব এপার্টমেন্টের মালিক – অনেকেই দেশে থাকেন না। আমি পঁচিশ তলায় থাকি। গ্যাস ফুরিয়ে গেছে – ফোন করলে সিলিন্ডার নিয়ে আসে একজন কানা ফারুক। যে ঘরটাতে কাজ করি সেখানে বাতির আলো কম – আলো বাড়াতে হবে, ইলেক্ট্রিসিয়ান ডাকি – একজন কানা ফারুক আসে, হাসি মুখে কাজ করে দিয়ে যায়, গল্প করে। যখনি নীচে নামি, হয় লিফট পরিষ্কার করে অথবা তীব্র গরমে ঘাস কাটে – কানা ফারুকরা। সালাম দেয়। একজন রোজার সময় ইফতারি করতে ডাকে ওদের সাথে – বলে এই কমপ্লেক্সে সব মিলিয়ে ৫২ জন কানা ফারুক থাকে, বিভিন্ন কাজে।
কুর্দিরা যখনি শোনে আমি বাংলাদেশের তখনি খুব খুশি হয়ে বলে বাঙালিরা খুব ভালো। সবাই এক বাক্যে বলে, তোমার দেশের যারাই এখানে আসে তারা অন্য যে কোনো দেশের মানুষের তুলনায় অনেক অনেক তাড়াতাড়ি কুর্দি এবং আরবি ভাষা শিখে যায়। ওরা খুব অবাক হয়, জিজ্ঞেস করে এটা কিভাবে পারে তোমার দেশের লোকেরা। কানা ফারুকদের এই অভাবনীয় ভাষা দক্ষতার কথা আমি জানতাম না – খুশি হই, অবাকও হই।
বালান বাজারে গ্রোসারি করতে যাই। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক কানা ফারুক কাজ করে ওখানে। চার বছর আগে এখানে এসেছে – কাগজ হয়েছে ছমাস আগে। কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হয়েছিল। পড়া শেষ করে নি। প্রমোশন হয়েছে কিছুদিন আগে – ফট ফট করে কুর্দি ভাষায় তর্ক করে ম্যানেজারের সাথে। জিজ্ঞেস করি, ঘটনা কি বলো তো, সবাই তোমরা এত তাড়াতাড়ি কুর্দি, আরবি শেখো কিভাবে ? বলে, ভাই, ওই যারারে দ্যাখসেন তারার অনেকেরই আকামা নাই। রাস্তা ঘাটে পুলিশে ধরলে, কুর্দি না জানলে কোনো কথা কইতে পারবো না – ধইরা জেলে ঢুকাইয়া দিবো। আর, ভালো চাকরিও পাইবো না। তাই প্যাটের ঠেলায় প্রথমেই ভাষা শিখ্যা ফেলে সবাই। যে কানা ফারুকরা দেশের স্কুল কলেজে বাংলা-ইংরেজি সব ভাষাতেই ফেল করে, যারা দেশে ভিজিটর খাতায় নাম লিখতে পারে না, তারাই বিদেশ বিভূঁইয়ে দ্রুততম সময়ে একাধিক ভাষা শিখে ফেলে – শিখে ফেলতে যে তাদের হবেই।
মধ্যপ্রাচ্যের আরেকটা দেশের রাজধানীর এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন কাউন্টারে বসে আছি। আমার অন এরাইভাল ভিসা দেওয়ার লোকটা কাউন্টারে নেই, দেরি হচ্ছে। বাঙালি দেখে একজন কানা ফারুক এগিয়ে এলো, পরিছন্ন কর্মী। কি সমস্যা জিজ্ঞেস করতে যখন শুনলো আমার ভিসা আছে এবং আকামা (রেসিডেন্সি এবং জব পারমিট) আছে তখন গলা নীচু করে বললো, কত লাগসে ? কোন কোম্পানির চাকুরী আপনের ? কোনোভাবেই বোঝানো গেলো না যে আমি যে সংস্থায় কাজ করি আমরা সহজেই সরকারের মাধ্যমে ভিসা ও আকামা পাই, কোনো পয়সা লাগে না। আরো চার পাঁচজন কানা ফারুক জড়ো হয়ে আমাকে ঘিরে দাঁড়ালো। সবার একই পোশাক, একই কোম্পানির চাকুরী – বিশাল এয়ারপোর্টে একই ধরণের কাজ। সবার একই প্রশ্ন, কিভাবে আমি তাদের সাহায্য করতে পারি আকামা পেতে, যারা আমার আকামা করেছে আমি কি তাদের নাম ঠিকানা ওদের দিতে পারি ?
আমি অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকি ওদের দিকে। এই এয়ারপোর্টে ৩০০ এর বেশি কানা ফারুক একটা কোম্পানির চাকুরী করে, এয়ারপোর্টের ভেতরেই থাকে, মেসের মতন, ছয় বছর আগে এসেছিলো, ভিসার মেয়াদ শেষ হয়েছে অনেক আগেই, ছয় বছর ধরে এয়ারপোর্টের নির্দিষ্ট সীমানার বাইরে যেতে পারে না, ওদের কারোরই ভিসা বা আকামা নাই। বাইরে গেলেই পুলিশ ধরে দেশে পাঠিয়ে দেবে। আর আসতে পারবে না। ছয় বছর ? ছয় বছর এই এয়ারপোর্টের ভিতরে ? হ্যাঁ। দেশে যান না ? না, দ্যাশে গেলে তো আর আইতে পারুম না। মাসে সব মিলিয়ে মাসে চারশো ডলার বাঁচাতে পারে এক একজন। ওইটা দেশে পাঠায়। ছয় বছর!! দাঁতে দাঁত কামড়ে আরো কতো বছর থাকতে পারবে, কে জানে ? পারতে যে হবেই এটা কানা ফারুকেরা জানে।
আমার ভিসার লোক এসেছে কাউন্টারে। কানা ফারুকেরা সালাম দিয়ে আমার হাতে একটা ঠান্ডা পানির বোতল দেয় – বলে, বাইরে অনেক গরম। কিন্তু সারি বেঁধে দাঁড়িযে থাকা কানা ফারুকেরা আমার দিকে অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে থাকে। আমাকে ঈর্ষা করে না ওরা, হয়তো নিজেদের ভাগ্যকে দোষ দেয় – কানা ফারুকেরা আমাদের মতো ঈর্ষায় নীল হয় না। কষ্ট সইতে সইতে ওরা কষ্টের বেদনায় নীলকণ্ঠ হয়, হয়তো।
কানা ফারুকদের সাথে দেখা হয় সবখানে, নিউ ইয়র্কে, লন্ডনে, কুয়ালালামপুরে, জোহানেসবার্গে, সিঙ্গাপুরে – এগিয়ে আসে, কথা বলে, কোনোদিন অভিযোগ করে না। দুনিয়ার কারো বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ নাই।
কানা ফারুকরা প্রতি বছর প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার পাঠায় দেশে (প্রায় আড়াই লক্ষ কোটি টাকা)। টাঁকশালে ছাপা হয়না ওই ডলার, ওদের কান্না, ঘাম, রক্তে তৈরী হয়। পদ্মা সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে হাসি মুখে সেলফি তোলে সবাই, মনে থাকে না যে পায়ের তলায় আছে কানা ফারুক – সে হয়তো কোনোদিন এখানে আসতে পারবে না। বেগমপাড়ায় কারো বাড়ি হয় – এয়ারপোর্টে আটকে থাকা কানা ফারুকের দীর্ঘশ্বাসের দামে, সুইসব্যাঙ্কে কারো একাউন্ট ফুলে ওঠে – একটু দূরে শ্যামনিতে কানা ফারুকের বিক্রি করা খাবারের টাকায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়তে আমার এক পয়সাও লাগেনি, উল্টো স্কলারশিপ পেয়েছি প্রতিমাসে – পয়সা কে দিয়েছে ? কানা ফারুক, ইরাকের-সৌদির-দুবাইয়ের ৫০ ডিগ্রি গরমে ঘাস কেটে। দেশের রিজার্ভ বেড়েছে কি কমেছে তা নিয়ে রাজনীতি হয় – মুজিব কোট এবং সাফারি পরা মানুষেরা কৃতিত্বের দাবি নিয়ে গলা ফাটান, আমলারা ঢেকুর তোলেন, ঝানু অর্থনীতিবিদেরা অংক কষেন, উঠতি-পড়তির জটিল গ্রাফ বানান। সত্য টা কি ? সত্যিকারের সত্য টা হচ্ছে, কানা ফারুকরা, রক্ত পানি করে ডলার পাঠালে রিজার্ভ আছে, না পাঠালে কিছুই নাই।
________________________________________________________________________
ইশতিয়াক মান্নান একজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। দীর্ঘদিন ধরে বেসরকারি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করছেন মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে। সম্পদের সীমাবদ্ধতার মধ্যে কিভাবে নবজাতকের মৃত্যু রোধ করা যায়, এই ছিলো তাঁর গবেষণার বিষয়। বাংলাদেশের মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। বাংলাদেশের বাইরে এশিয়া, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক প্রকল্প ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে সহায়তা করছেন। শখের বশে লেখালেখি করতে পছন্দ করেন। মানুষের জীবন, মনন ও আচরণের বৈচিত্র তাঁর আগ্রহের বিষয়।
e-mail: ishtiaqmannan@yahoo.com
খুব ভালো লাগল পরে