অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশীদের প্রথম অভিবাসন কখন হয়েছিল, এর সুনির্দিষ্ট তথ্য কোথাও পাওয়া যায়নি। তবে দুহাজার উনিশ সালে নিউ সাউথ ওয়েলসের ব্রোকেন হিল শহরে আঠারশ পঁচাশি সালের দিকে নির্মিত একটি মসজিদ থেকে বাংলা পুঁথি পাওয়ার পর ধারণা করা হয়, অস্ট্রেলিয়ায় বাংগালীদের আগমন শত বছরেরও আগে আফগানদের হাত ধরেই। (See “The Bengali Diaspora in Australia” by Mostafa Abdullah, Global Bangladesh, Vol. 1, Issue 1, https://globalbangladesh.org/the-bengali-diaspora-in-australia-by-mostafa-abdullah/)
এখানে জানিয়ে রাখি, ব্রিটিশরা আঠারো শতকের শেষ দিকে কঠোর পরিশ্রমী আফগান উট বাহকদের অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে আসে, মূলত মরুভূমিতে রেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতেই। আজকের সিডনি থেকে এডিলেইডের ট্রেন লাইন তৈরীতে আফগানদের ভূমিকা সিংহভাগ। এ সকল মুসলিম আফগান শ্রমিকরা ব্রোকেন হিলে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিল। ধারণা করা হয় সেই সময় কলকাতা থেকে কিছু বাংগালী নাবিক আফগানদের হাত ধরেই অস্ট্রেলিয়ায় বসতি স্হাপন করে। যদিও কালক্রমে এদের বংশধরদের অধিকাংশই অস্ট্রেলিয়ানদের সাথে বিলীন হয়ে গেছে।
উন্নিশ ছিষট্রি সালে অস্ট্রেলিয়ান গর্ভনমেন্ট হোয়াইট অস্ট্রেলিয়ান পলিসি রদ করার পর থেকেই অস্ট্রেলিয়া নন ইউরোপিয়ান ইমিগ্রেন্টদের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। আর বাংলাদেশেীদের মাইগ্রেশনের শুরুটা মূলত এর পর থেকেই। সত্তর দশক থেকেই স্কিলড মাইগ্রেশন নিয়ে বাংলাদেশীদের অস্ট্রেলিয়ায় পদচারনা শুরু হয়ে যায়। যদিও এর আগে থেকেই কিছু বাংলাদেশী স্কলার বৃত্তি নিয়ে এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়তে এসেছিল। এদর কেউ কেউ স্হায়ীভাবে এদেশে থেকেও যায়।
বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় কতজন বাংলাদেশীর বসবাস তার সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে দু হাজার একুশ সালের অফিসিয়াল আদমশুমারী অনুযায়ী বাংলাদেশী অস্ট্রলিয়ানদের সংখ্যা একান্ন হাজার চার শত একান্নব্বই। দু হাজার ষোল সালের আদমশুমারী অনুযায়ী এ সংখ্যা ছিল একচল্লিশ হাজার দুশত সাইত্রিশ। অর্থাৎ পাঁচ বছরে অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশীদের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় দশ হাজার।
যদিও এই তথ্যটা মোটেও অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশীদের প্রকৃত অবস্হা বর্ণনা করে না। অস্ট্রেলিয়ায় এখন অগনিত বাংলাদেশী স্টুডেন্ট, রিফুইজি বা এসাইলাম সিকার, টেম্পররারি ভিসাধারী এমনকি অবৈধভাবে বসবাসকারী অনেক বাংলাদেশীও রয়েছে। তাইতো বাংলাদেশেীদের সংখ্যা লাখ পেরিয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশীদের বতর্মান অবস্থান বিশ্লেষন করার আগে দেশটি সম্পর্কে সংক্ষেপে জানিয়ে রাখি। ছিয়াত্তুর লক্ষ স্কয়ার কিলোমিটারেরও বেশি আয়তনের এই দেশটি পৃথিবীর ষষ্ঠ বৃহত্তম দেশ আর ওসেনিয়া দেশ গুলোর মধ্যে বৃহৎ। দেশটির বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ছাব্বিশ মিলিয়ন বা দু কোটি ষাট লক্ষ।
সতেরশ আটাশি সালে ইউরোপিয়ান সেটেলারদের আগমনের পূর্বে বৃহৎ এই দেশটি আদিবাসীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। সে সূত্রে পুরো ল্যান্ডের মালিকানা এবোরিজিনালদের, সরকারও এটা স্বীকার করে।
পার্লামেন্টারি গনতন্ত্র নির্ভর অস্ট্রেলিয়া পাঁচটি স্টেট ও দুটি টেরিটরির সমন্বয়ে গঠিত ফেডারেল গর্ভনমেন্টের মাধ্যমেই আইন প্রনয়ন করে থাকে। তিন স্তর বিশিষ্ট অস্ট্রেলিয়ান সরকারের প্রথম স্তর স্হানীয় সরকার বা সিটি কাউন্সিল। দ্বিতীয় স্তর রাজ্য সরকার যা অনেকগুলো কাউন্সিলের সমন্বয়ে গঠিত আর সর্বশেষ হল কেন্দ্রীয় সরকার। সবগুলো সরকারই কিন্তু নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে গনতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হয়।
অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরা। যদিও প্রত্যেকটি স্টেট গভর্নমেন্টের আলাদা আলাদা রাজধানী রয়েছে। যেমন নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যের রাজধানী সিডনি আর ভিক্টোরিয়ার হল মেলবোর্ন। অস্ট্রেলিয়ার ওয়েদার রাজ্য ভেদে ভিন্ন হলেও মূলত আবহাওয়ায় চারপাশ বেস্টিত সমুদ্রের প্রভাব রয়েছে।
অটাম, সামার, স্প্রিং আর উইন্টার এই চার ঋতুর দেশ অস্ট্রেলিয়ায় সামুদ্রিক আবহাওয়ার প্রভাবে খরা, সাইক্লোন কিংবা বন্যা হওয়াটা কিন্তু কমন। তবে মোটের উপর অস্ট্রেলিয়ার আবহাওয়া বেশ সহনশীল, শীত বা গরম দুটোই মাত্রার মধ্যে থাকে। তাইতো বাংলাদেশ থেকে আগতদের অস্ট্রেলিয়ার ওয়েদারে মানিয়ে নিতে খুব একটা সমস্যা হয় না।
লেখার মূল প্রসঙ্গে আসি। অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশীদের জীবন যাপনের গল্প। প্রথমেই শুরু করি অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশীরা কিভাবে মাইগ্রেট করে থাকেন। মূলত দুটো উপায়েই অধিকাংশ বাংলাদেশীদের এই দেশে আসা। এক. স্কিলড মাইগ্রেশন নিয়ে আর দ্বিতীয়টি স্টুডেন্ট ভিসার মাধ্যমে। যদিও স্পাউস, ফ্যামিলি, এসাইলাম সিকিং বা অন্যান্য টেম্পোরারি ভিসাতেও অনেকে এদেশে এসে স্হায়ী হয়ে থাকে। তবে তার সংখ্যা উপরের দুই ক্যাটাগরির চেয়ে অনেক কম।
মাইগ্র্যান্ট ফ্রেন্ডলি অস্ট্রেলিয়ান গভর্নমেন্ট কিন্তু সারা বিশ্বের দক্ষ জনশক্তিকে তাদের দেশে সবসময়ই স্বাগত জানায়। স্কিলড বা দক্ষ জনশক্তির ক্যাটাগরি এবং এই ভিসার যোগ্যতা থাকলেই সরকার আবেদনকারীকে ভিসা দিয়ে থাকে। এই ভিসায় আগতরা সাধারণত পারমানেন্ট রেসিডেন্স (পিআর) বা টেম্পরারি রেসিডেন্স (টিআর) ভিসা পেয়ে থাকেন। এই দুই ক্যাটাগরির ভিসা প্রাপ্তরাই কিন্তু একটা সময় পর কিছু শর্তপূরনের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়ান সিটিজেনশিপ পেয়ে যায়।
এবার প্রাসঙ্গিকভাবেই বলছি, অস্ট্রেলিয়ায় আগত বাংলাদেশীরা কোন শহরে বেশি বাস করে এবং কি কারণে? অভিবাসীরা মূলত নিজেদের সুযোগ সুবিধা বুঝেই বিদেশে পছন্দের শহরকে বেছে নেয়। তবে স্টুডেন্টরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যে শহরে অবস্হিত, সেখানেই আসতে বাধ্য থাকে।
দু হাজার একুশ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসকারী প্রায় আটান্ন শতাংশ বাংলাদেশী সিডনি শহরে বসবাস করে। আর মেলবোর্ণে আছে প্রায় বিশ শতাংশ। আর বাকি বাংলাদেশীরা অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ইদানীং অস্ট্রেলিয়ান সরকার রিজিওনাল ভিসার মাধ্যমে মাইগ্র্যান্টদের রুরাল এলাকায় যাওয়ার জন্যও উৎসাহিত করছে। তাইতো বাংলাদেশীদের কম বেশি সব জায়গাতেই দেখা যায়।
মাইগ্র্যান্টরা কেনো বড় শহরে থাকতে পছন্দ করে? এর প্রধান কারণ, জীবিকার সুযোগ বেশি বলেই। আর স্বভাবতই মাইগ্র্যান্টদের সিডনির মতো শহর পছন্দ, এর কসমোপলিটন ন্যাচারের জন্যই। বাংলাদেশী একটা বড় কমিউনিটি অলরেডি তৈরী হয়ে গেছে, এটাও হয়তো অন্যতম কারণ।
এবার বাইরের লোকদের অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রতি থাকা সবচাইতে আগ্রহের বিষয়টি নিয়েই কথা বলবো। মাইগ্র্যান্টরা অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে কি ধরনের কাজ করে থাকেন। আমাদের কমন পেশাগুলো কি?
শুধুমাত্র অস্ট্রেলিয়া নয় পৃথিবীর সব জায়গাতেই দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাগত যোগ্যতার ভিত্তিতেই চাকুরী বা ব্যবসার সুযোগ মেলে। অস্ট্রেলিয়াতেও অভিবাসীরা নিজ নিজ যোগ্যতায় বিভিন্ন সেক্টরে এমনকি কেউ কেউ উচুঁ পদেও সুনামের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। তবে মাইগ্র্যান্টদের একটা বড় অংশ কিন্তু ব্যবসা বা স্বাধীন পেশাতেও জড়িত। সত্য বলতে কি বাংলাদেশী বিশাল মাইগ্র্যান্ট জনগোষ্ঠী এখন কমবেশি সব পেশাতেই আছেন। তবে কিছু স্পেসিফিক প্রফেশনের কথা বলছি, যেখানে বাংলাদেশীদের উপস্হিতি লক্ষ্যনীয় ও বলার মতো।
মেডিসিন: বাংলাদেশ থেকে পাশ করে আসা অনেক ডাক্তারই এখন অস্ট্রেলিয়ায়। এদের বড় একটা অংশই অস্ট্রেলিয়ান মেডিক্যাল কাউন্সিলের কোয়ালিফাইং এক্সাম পাশ দিয়ে, মেডিক্যাল বোর্ড রেজিস্ট্রেশন নিয়ে ডাক্তার হিসেবে কাজও করছেন। দেশ জুড়ে নানা হসপিটাল কিংবা জিপি সেন্টারে কাজ করা এই সকল ডাক্তারদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্হান এ দেশে খুব ভালো। সোসাইটিতে এরা নোটেবল কন্ট্রিবিউটরও।
প্রকৌশল ও তথ্যপ্রযুক্তি: বাংলাদেশ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং বা আইটি প্রফেশনালদের অনেকেই অস্ট্রেলিয়ায় এখন বেশ ভালো চাকুরী করছেন। এই সব ডিগ্রীগুলো অস্ট্রেলিয়ায় গ্রহণযোগ্য, তাই কাজের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা থাকলে ডিগ্রীধারীদের সরাসরি জব পাওয়া সম্ভব। ট্র্যান্সফারেবল স্কিলস। তবে মনে রাখতে হবে শুধু ডিগ্রী থাকলেই কিন্তু এদেশে চাকুরী পাওয়া যায় না। প্রফেশনাল দক্ষতা আর সেই সাথে ভালো কমিউনিকেশন স্কিলস দুটো থাকা বেশ জরুরী। আর সেই সাথে অস্ট্রেলিয়ান কালচার আর ভ্যালুজ সম্পর্কে ধারনা থাকাটাও সম্যক জরুরী। আইটি প্রফেশনাল বিশেষ করে কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে পারদর্শীদের জন্য অস্ট্রেলিয়া এখনো স্বর্গরাজ্য।
শিক্ষা ও গবেষণা: উল্লেখযোগ্য বাংলাদেশী এখন অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন ভার্সিটির ফ্যাকাল্টি মেম্বার বা সিনিয়র গবেষক। প্রতিবছরই বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশী অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রীও অর্জন করেন। এদের সাথে এখানকার স্কুল গুলোতেও বাংলাদেশী শিক্ষক হিসেবে কাজ করছে। ভালো একাডেমিক হিসেবে অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশীদের কিন্তু বেশ সুনামও রয়েছে।
সরকারি চাকুরী: অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশীরা কাউন্সিল, স্টেট বা ফেডারেল গভর্নমেন্টের বিভিন্ন পদেও কর্মরত রয়েছে। সংখ্যায় খুব বেশি না হলেও সময়ের সাথে সরকারি চাকুরীতে বাংলাদেশীদের সংখ্যা বাড়ছে। এদের মধ্যে অনেকেই নিজ মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে সরকারের এক্সিকিউটিভ পদে, আবার এমনকি দু একজন সিনিয়র এক্সিকিউটিভ পদেও রয়েছেন। প্রসঙ্গত লেখক নিজেও বর্তমানে গর্ভনমেন্টের এক্সিকিউটিভ পদে কর্মরত রয়েছেন।
একাউন্টিং ও ব্যাংকিং: বাংলাদেশেীদের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ অস্ট্রেলিয়ায় একাউন্টিং প্রফেশনাল। এদের কেউ কেউ স্বাধীনভাবে নিজের ব্যবসাও করেন। আর ব্যাংকিং সেক্টরে একেবারে কাস্টমার সার্ভিস থেকে শুরু করে কর্পোরেট উঁচু পদেও কিন্তু বাংলাদেশীরা কাজ করে যাচ্ছে সুনামের সাথে।
উপরোল্লিখিত প্রফেশন ছাড়াও বাংলাদেশীদেরা কমবেশি সবধরনের পেশাতেই আছেন। লইয়ার, এলাইড হেলথ, নার্স, চাইল্ড কেয়ার এসিসট্যান্ট, রিয়েল এস্টেট এজেন্ট, মার্কেটিং, কাস্টমার কেয়ার, কল সেন্টার সহ সব ধরনের পেশাতেই অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশীদের পদচারনা।
স্বভাবতই আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে। অস্ট্রেলিয়ায় মাইগ্রেশন নেওয়া সবাই কি তাহলে ভালো জব করে বা পায়? খুব কমন এই প্রশ্নের উত্তর, অধিকাংশ বাংলাদেশীই কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় অফিস জব করেন না। এখানে এমনকি অনেকেই চাকুরীর পথই মাড়ান না। বেচে থাকার হাজারো সুযোগটা রয়েছে বলেই।
কিন্তু তাই বলে কেউই কিন্তু মোটেও খারাপ অবস্হায় নেই। বাংলাদেশীদের বড় একটা অংশ হসপিটালিটি ও ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রি যেমন রেস্টুরেন্ট, হোটেল, ট্যাক্সি, উবার কিংবা সিকিউরিটি গার্ডের চাকুরী করেও বেশ ভালো আছে। এর একটাই কারণ এ ধরনের চাকুরীর বেতন বা আয় কিন্তু কম না। তাছাড়া বেশ কিছু বাংলাদেশী বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা বা দোকান রেস্টুরেন্টও চালায়। তাদের আয় রোজগারও বেশ ভালো।
এখানে একটা কথা বলে রাখি। অস্ট্রেলিয়া একটি সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার টাইপের দেশ। সরকার তার নাগরিকদের পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করে থাকেন। নিম্ন আয়ের পরিবারকে সরকার প্রয়োজন মাফিক ভাতা প্রদান ও অন্যান্য সুবিধা প্রদান করে থাকে। যার ফলে যারা অস্ট্রেলিয়ায় স্হায়ী তাদের কারোরই কিন্তু অন্ততপক্ষে থাকা খাওয়ার কষ্টটা নেই। তাইতো কমিউনিটিতে এমন কিছু বাংলাদেশীও রয়েছে, যাদের মূল আয় এই সরকারি সহযোগিতাটুকু। তারাও কিন্তু এর উপর নির্ভর করে জীবন ভালো ভাবেই চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সকলের ছেলে মেয়েরাই পড়াশোনা করে সমাজে প্রতিষ্ঠাও পাচ্ছে।
অস্ট্রেলিয়ার মূল ধারা রাজনীতিতে সরব উপস্হিতি, এ দেশে বাংলাদেশীদের ভালো অবস্হানের বার্তাটাই দেয়। ইতোমধ্যে বৃহৎ তিনটি রাজনৈতিক দল লেবার, লিবারেল বা গ্রীন পার্টির নমিনেশন নিয়ে বাংলাদেশীরা কাউন্সিল, রাজ্য এমনকি ফেডারেল ইলেকশনও করেছে। সম্প্রতি নিউ সাউথ ওয়েলসের বিভিন্ন কাউন্সিল নির্বাচনে বাংলাদেশী পাঁচজন কাউন্সিলরের নির্বাচিত হওয়াকে অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতিতে বাংলাদেশীদের অর্জনের মাইলফলকই বলা যায়। অস্ট্রেলিয়ার মূলধারা রাজনীতিতে বাংলাদেশীদের অবস্হান আগামীতে আরো জোরালো হবে বলেই কমিউনিটি নেতৃবৃন্দের দৃঢ় বিশ্বাস।
এবার স্টুডেন্ট, টেম্পরারি ভিসা বা সদ্য আগত মাইগ্রেন্টদের জব করার গল্পটা বলবো। সত্য বলতে কি, এ শ্রেনীর লোকদের টাকার প্রয়োজনে সবধরনের কাজই করতে হয়। তাইতো রেস্টুরেন্ট কিচেন হ্যান্ড, ক্লিনিং, ফ্যাক্টরি ওয়ার্ক, উবার, ট্যাক্সি ড্রাইভিং, কার ওয়াশ, ট্রেড, হোটেল রুম সার্ভিস, এজড কেয়ার, ডেলিভারি, দোকান, পেট্রোল পাম্প কিংবা সুপার মার্কেটের জবগুলোতে এ শ্রেনীর মাইগ্র্যান্টদের উপস্হিতি লক্ষ্যনীয়। তবে আশার কথা এসব জব করেও অনেক স্টুডেন্ট নিজের খরচ নিজে ম্যানেজ করে এমনকি টিউশন ফিও দিয়ে দেয়। অস্ট্রেলিয়ায় মিনিমাম ওয়েজ একটা স্ট্যান্ডার্ড মেইনটেইন করে বলেই এটা সম্ভব হয়। তাইতো স্টুডেন্টদের জন্য অস্ট্রেলিয়া সবসময়ই পছন্দের একটি দেশ।
আমার এই ছোট্র লেখাটায় বাংলাদেশীদের পেশাগত বৈচিত্র্যের সব কথা লেখা সম্ভব নয়, তবে প্রথমেই বলে নিয়েছি বাংলাদেশীদের উপস্হিতি এখন প্রায় সবধরনের পেশাতেই রয়েছে। আর সেটা কিন্তু মেয়ে ও ছেলে উভয়েরই। চাকুরী, ব্যবসা এমনকি রাজনীতিতে বাংলাদেশী মেয়েদের অবস্থানও ঈর্ষণীয়। কেউ কেউ পেশাগত সফলতার শীর্ষেও পৌছেছেন।
এবার বাংলাদেশীদের অস্ট্রেলিয়ায় জীবন প্রসঙ্গে খাবার বিষয়টি আনবো। ফ্রেশ ফুড ও ডেইরীর জন্য অস্ট্রেলিয়া সারা পৃথিবী জুড়ে বিখ্যাত। আর সুপার মার্কেটের মাধ্যমে কেনা নানা রকম গ্রোসারীজ ও ফুড আইটেমের দামও অনেকটাই সাধ্যের মধ্যে।
আর বাংলাদেশী বা ইন্ডিয়ান গ্রোসারিজ সপগুলোর মাধ্যমে আপনি বাংলাদেশী সব প্রডাক্টই পেয়ে যাবেন। আশ্চর্য হলেও সত্যি, দেশে আমরা যেসব আইটেম খুঁজে পেতাম না, অস্ট্রেলিয়ায় সেসব বাংলাদেশী আইটেম এইসব দোকানে পেয়ে যাবেন অবলীলায়। আর হরেকরকম ফ্রোজেন দেশি মাছ বা দেশি সব্জিতো রয়েছেই। তাইতো “আজ কি দিয়ে খেয়েছো?” আপনার করা এই প্রশ্নটায় অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বন্ধুটি যদি বলে থাকে “চ্যাপা শুটকির ভর্তা আর ইলিশ মাছের ভাজা।”। এতে মোটেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
আর রেস্টুরেন্ট। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো অস্ট্রেলিয়াতেও ভ্যারাইটিজ ফুডের রেস্টুরেন্টর বাহার। আপনি চাইলে বাংলা ইন্ডিয়ান কুইজিন থেকে শুরু করে সাউথ আমেরিকান খাবারও পাবেন। যদিও বড় শহরে রেস্টুরেন্টের ভ্যারিয়েশন বেশি আর দামও তুলনামূলক কম।
একটা কথা জানিয়ে রাখছি অস্ট্রেলিয়ায় কিন্তু বাংলাদেশের মতো খাবারের পিছনে আপনার আয়ের বড় একটা অংশ খরচ হয়ে যাবে না। খাবারের দাম আয় অনুযায়ী অনেকেই কম, অন্ততপক্ষে আমার মতে। অস্ট্রেলিয়ায় মাঝারী আয়ের একজনের বেতনের সর্বোচ্চ বিশ শতাংশ ব্যয় করলেই, এখানে আপনি পরিবার সহ ভালোভাবে খেয়ে পড়ে থাকতে পারবেন।
এবার বলবো বাসস্হানের কথা। পৃথিবীর সব দেশের মতোই মাথা গোজার ঠাই ম্যানেজ করা অস্ট্রেলিয়াতেও কঠিন। আপনার আয়ের বড় অংশ একটা ব্যয় হয়ে যাবে বাসস্হান নিশ্চিত করতেই। অস্ট্রেলিয়ায় আপনি বাসা (ফ্ল্যাট, টাউনহাউজ, ভিলা বা ইন্ডিভিজুয়াল বাড়ি) ভাড়া পাবেন, আর অবশ্যই বাসার ভাড়াটা লোকেশন ও প্রপার্টি টাইপের উপর নির্ভর করবে।
আবার আপনার যদি স্টেবল ইনকাম সোর্স থাকে, চাইলে ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে পছন্দ ও সাধ্যমতো প্রপার্টিও কিনতে পারেন। ব্যাংক মর্টগেজ এই প্রপার্টি গুলো সাধারণত পঁচিশ বা তিরিশ বছর মেয়াদী লোনের হয়ে থাকে। সম্পূর্ণ লোন পরিশোধ হলেই এসব সম্পত্তির মালিকানা নিশ্চিত হয়। আর আপনার যদি পুরো টাকা একসঙ্গে দিয়ে বাড়ি কেনার সামর্থ্য থাকে, সে ক্ষেত্রে আপনি আপনার মালিকানা তাৎক্ষণিকভাবেই নিশ্চিত করতে পারবেন।
এছাড়া অস্ট্রেলিয়া গর্ভনমেন্ট স্বল্প আয় বা সমাজের ভালনারেবল মানুষদের জন্য নাম মাত্র মূল্যে বাসস্হানও নিশ্চিত করে থাকে। যদিও এ ধরনের একমোডেশেন চাইলেই পাওয়া যায় না, অনেক লম্বা সময় পেরিয়ে যাচাই বাছাই শেষেই এইসব সরকারি “হাউজিং” এ ঠাই হয়। বাংলাদেশেীদের এই ধরনের হাউজিংয়ে বসবাস খুব বেশী নয়। আর সত্যি বলতে কি পাবলিক হাউজিংগুলো স্বাভাবিক ভাবেই অপরাধ প্রবন ও সহিংসতা থাকে বলে, অনেকেই এখানে বসবাস করতে আগ্রহী থাকে না।
এইবার হয়তো আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে। প্রপার্টির দাম কেমন? আগেই বলেছি দাম নির্ভর করবে কোন এলাকায় ও কি ধরনের প্রপার্টি কিনছেন তার উপর। স্বাভাবিকভাবেই দামি সাবার্বের প্রপার্টির দাম বেশি হবে। তাইতো লোকজন তাদের সাধ্যানুযায়ী ও সুবিধা বুঝেই বাসা নেয়। সাম্প্রতিক কালে অস্ট্রেলিয়ায় বাড়ি ঘরের দাম বেড়ে যাচ্ছে, তাইতো প্রপার্টির মালিকানা এখন অনেকেরই ধরাছোঁয়ার বাইরে।
এবার অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসকারীদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি এসপেক্ট সম্পর্কে বলবো “শিক্ষা”। অস্ট্রেলিয়ায় প্রাইমারি শিক্ষা সবার জন্যই বাধ্যতামূলক। এখানকার প্রাইমারি স্কুলগুলো কিন্ডারগার্টেন থেকে সিক্স আর হাইস্কুল গুলো সেভেন থেকে এইচএসসি পযর্ন্ত হয়ে থাকে। সরকারি স্কুলগুলো এদেশে পর্যাপ্ত ও টিউশন ফি ফ্রি। তাইতো আপনার ছেলেমেয়েকে এইচএসসি পযর্ন্ত পড়াতে খুব একটা টাকা পয়সা খরচ হবে না। তবে আপনি যদি আপনার বাচ্চাদের প্রাইভেট স্কুলে পড়াতে মনস্হ করেন, সেক্ষেত্রে আপনাকে স্কুল ভেদে অনেক টাকাই গুনতে হবে। কিছু কিছু প্রাইভেট স্কুলের বাৎসরিক টিউশন ফি বাংলাদেশী টাকায় পনের থেকে বিশ লক্ষ টাকা পযর্ন্তও হয়ে থাকে।
এদেশে রিলিজন বেজড কিছু স্কুলও কিন্তু রয়েছে। মূলধারার শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্য রেখে এসব স্কুলগুলোতে ধর্মীয় শিক্ষাও দেওয়া হয়। তাইতো ক্যাথলিক, এংলিকান, এমনকি ইসলামিক স্কুলও এখন অস্ট্রেলিয়ায় কমন। মোট কথা অস্ট্রেলিয়ার সরকার আপনার বাচ্চার শিক্ষা নিশ্চিত করে থাকে। আর আপনার হাতেও স্কুলের বিভিন্ন অপশন রয়েছে, নিজের সাধ্য ও পছন্দ মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি বেছে নিতে পারেন।
এবার উচ্চশিক্ষা সম্পর্কে। প্রথমেই জানিয়ে রাখি অস্ট্রেলিয়ার ভার্সিটির টিউশন ফি কিন্তু তুলনামূলকভাবে অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক বেশি। এমনকি সিটিজেন বা স্হায়ী বাসিন্দাদের জন্যও। তবে সরকার কারিগরি শিক্ষাকে উৎসাহিত করে বলে Technical And Further Education (TAFE) বা কারিগরি কলেজগুলোর টিউশন ফি নামমাত্র।
এখানে বলে রাখি অস্ট্রেলিয়ানদের বড় একটা অংশই এইচএসির পর আর পড়াশোনা করে না। চাকুরী বা জীবিকায় নেমে যাওয়া অনেকেই পরবর্তীতে ট্যাফ বা ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে থাকে। আর কারিগরি বা ট্রেড প্রফেশনালদের (ইলেক্ট্রিশিয়ান, প্লাম্বার, বিল্ডার, রংমিস্ত্রি ইত্যাদি) আয়ও কিন্তু অনেক ভালো। তাইতো অনেক মেধাবীরাও ট্রেডকেই তাদের প্রফেশন হিসেবে নিয়ে নেয়।
ভার্সিটিতে টিউশন ফি বেশি, বাংলাদেশীরা তাদের ছেলেমেয়েদের তাহলে কিভাবে পড়ায়? ভয় পাওয়ার কিছু নেই সরকার আছে।
অস্ট্রেলিয়ান সরকার তার নাগরিকদের ভার্সিটি পড়ার সহায়তার জন্য Higher Education Contribution Schemes (HECS) চালু রেখেছে। এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে সরকার ভার্সিটির টিউশন ফি ছাত্রদের প্রদান করে থাকে, শর্তসাপেক্ষে। লোনের এই টাকাটা ছাত্ররা যখন চাকুরী বা আয় করা শুরু করবে, তাদের কাছ থেকে প্রতিবছর অল্প অল্প করে সরকার নিয়ে নিবে, শর্ত এটাই।
এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি যুদ্ধের কথা বলবো। না অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ভর্তি হতে হলে কোন ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয় না। মূলত এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতেই ছাত্ররা তাদের পছন্দের সাবজেক্ট চুজ করে বা পায়। ভালো সাবজেক্ট যেমন মেডিসিন পড়তে হলে আপনার ছেলে বা মেয়েকে এইচএসসিতে একেবারেই প্রথম দিকের রেজাল্ট (ধরুন টপ ফাইভ পার্সেন্ট বা তারও ভালো) থাকতে হবে। অস্ট্রেলিয়ায় কিন্তু ছাত্রদের পছন্দানুযায়ী নানা সাবজেক্টে পড়ার সুযোগ আছে। আর একটা কথা বলছি এ দেশে ভার্সিটিতে ভর্তির কোন নির্দিষ্ট বয়স ওনেই। ভার্সিটিতে অনেক বয়স্ক ছাত্রও দেখা মিলে। চাইলে মাইগ্রেশন নিয়ে আপনিও আপনার পছন্দের সাবজেক্টে ভর্তি হয়ে যেতে পারেন।
অস্ট্রেলিয়ান সরকার এদেশের নাগরিকদের ফ্রি চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করে। সরকারি হাসপাতালে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা এমনকি বড় বড় সার্জারিও করাতে পারবেন আপনি বিনা পয়সায়। সার্জারী বা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসার জন্য অনেক সময় লম্বা ওয়েটিং টাইম থাকতে পারে। তবে হাসপাতাল গুলোতে জরুরী চিকিৎসা ব্যবস্হা রয়েছে চব্বিশ ঘন্টা, আর তা অবশ্যই বিনা পয়সায়।
পাবলিক হসপিটালের পাশাপাশি চাইলে আপনি প্রাইভেট হসপিটালেও টাকার বিনিময়ে চিকিৎসা নিতে পারেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরাও চেম্বার খুলে বসে আছেন, প্রাইভেটলি দেখাতেও পারেন । তবে এ কথা সত্য, প্রাইভেট চিকিৎসা অস্ট্রেলিয়ায় ব্যয়সাধ্য। আর এজন্য অস্ট্রেলিয়ানদের বড় একটা অংশ প্রাইভেট হেলথ ইন্সুরেন্স (উদাহরন বুপা) মেইনটেইন করে থাকে। এক্ষেত্রে আপনাকে কোম্পানিকে বাৎসরিক ইন্সুরেন্সের টাকা দিয়ে যেতে হবে। যদি কখনো প্রাইভেট হসপিটালে চিকিৎসা নিতে হয়, সেক্ষেত্রে ইন্সুরেন্সই আপনার সিংহভাগ খরচ বহন করবে। যদিও হেলথ ইন্সুরেন্স ব্যয়বহুল, কিন্তু এটা আপনার পিস অফ মাইন্ড এনশিউর করে।
হসপিটাল চিকিৎসা ব্যবস্হা ছাড়াও সরকার জনগনের জন্য মাঠ পর্যায়ে প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সিস্টেমের ব্যবস্হা রেখেছে। অস্ট্রেলিয়ানদের চিকিৎসা নেওয়ার প্রাথমিক জায়গা এদেশের জিপি সেন্টারগুলো। বিস্তৃত অস্ট্রেলিয়ায় যথেষ্ট পরিমাণ হসপিটাল নেই, তাইতো সংখ্যাগরিষ্ঠ অস্ট্রেলিয়ানদের প্রাথমিক চিকিৎসা এই জিপি সেন্টারগুলোর মাধ্যমেই সরকার নিশ্চিত করে থাকে। সাধারণত পেশেন্টের কন্ডিশন নিয়ন্ত্রণে না থাকলেই জিপিরা নিকটবর্তী হসপিটালে রেফার করে থাকে। প্রসঙ্গত পুরো অস্ট্রেলিয়াতেই বাংলাদেশী জেনারেল প্রাকটিশনারদের উপস্হিতি লক্ষ্যনীয়।
এবার অস্ট্রেলিয়ান জনগন কিভাবে ডাক্তার বা হসপিটাল খরচ নির্বাহ করে থাকে। অস্ট্রেলিয়ান সরকার Medicare প্রোগ্রামের মাধ্যমেই নাগরিকদের চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহ করে থাকে। এ দেশের স্হায়ী বাসিন্দাদের প্রত্যেকেরই সরকারি মেডিকেয়ার কার্ড আছে। এই কার্ড ব্যবহার করেই নাগরিকরা প্রাইমারি হেলথ কেয়ার বা হসপিটাল ফ্যাসিলিটিজ নিতে পারে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিনামুল্যে বা নামমাত্র মূল্যে। তবে আগেই বলেছি মেডিকেয়ার কিন্তু প্রাইভেট হসপিটাল বা প্রাইভেট চিকিৎসকদের বিল প্রদান করে না, বা ক্ষেত্র বিশেষে হয়তো আংশিক সহায়তা দেয়।
চিকিৎসা সেবার পর এবার খুব সেন্সিটিভ একটা টপিক নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি। আর সেটা অস্ট্রেলিয়ান ও বাংলাদেশী কালচারাল কনফ্লিক্টের কথা। তবে এ বিষয়টিতে লেখকের ব্যক্তিগত মতামত বলেই ধরে নিবেন।
বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ান কালচারে কিন্তু যোজন যোজন পার্থক্য। শুধু কালচার নয় ধর্ম, খাবার কিংবা আচার আচারনেও অনেক ভিন্নতা রয়েছে। তাইতো আমার মতো অধিকাংশ বাংলাদেশী মাইগ্রেন্টের এই কালচারে মানিয়ে নেওয়া অনেক কষ্টের।
প্রথমেই ভাষার বিষয়টি চলে আসবে। ইংরেজি আমাদের জন্য নতুন না হলেও বাংলাদেশ থেকে বাংলা মিডিয়ামে পড়ে আসা অনেকের কাছেই ইংরেজিটা দূর্বোধ্য ঠেকে। বিশেষ করে রিটেন ইংলিশটা। আর ভারবাল ইংরেজির অস্ট্রেলিয়ান একসেন্টটাও একটু ডিফরেন্ট হয়। তাইতো বাংলাদেশীদের অনেকেই ইংরেজিতে দক্ষ নয় বলে চাকুরী পাওয়া বা ধরে রাখা কষ্ট হয়ে যায়।
আর অস্ট্রেলিয়ানদের কালচার পুরোপুরি পাশ্চাত্য নির্ভর। বাংলাদেশীদের চেয়ে ভিন্ন। তাইতো ক্রিসমাস, ইস্টার কিংবা অন্য পাশ্চাত্য নির্ভর উৎসবে আমরা বাংলাদেশীরা হলিডে বা নিজেদের মধ্যে দাওয়াত খেয়েই কাটিয়ে দেই। আর অস্ট্রেলিয়ানদেরও আমাদের এই সীমাবদ্ধতার কথাটা জানা। তাইতো কালচারাল এই কনফ্লিক্টটা অনেকটাই ভিজিবল হলেও সহনীয় মাত্রাতেই আছে। তবে অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশী দ্বিতীয় প্রজন্ম কিন্তু খুব ভালো করে সমস্যাটাকে ব্যালেন্স করে, অস্ট্রেলিয়ানদের সাথে ওরা অনেক ভালোই আছে।
হাতে গোনা দুএকজন বাদে অস্ট্রেলিয়ানরা সব ধর্মের প্রতিই সমান শ্রদ্ধাশীল। যদিও মিডিয়ার নেতিবাচক সংবাদে মুসলিমদের সম্পর্কে স্বল্প শিক্ষিত অস্ট্রেলিয়ানদের একটা নেগেটিভ ধারনা আছে। তবে বড় শহরে আপনি হিজাব পড়ে কাজে গেলেও কেউই অবাক হয় না। আর বেশিরভাগ কর্মক্ষেত্রেও আপনার জন্য এমনকি নামাজ পড়ার সুযোগ আছে। সবমিলিয়ে ধর্মীয়ভাবে অস্ট্রেলিয়া অনেক সহনশীল। সব শহরেই এখন মসজিদ, মন্দির বা উপাসানালয় রয়েছে।
এবার নাগরিকদের অস্ট্রেলিয়ান গর্ভনমেন্টের প্রদেয় সুযোগ সুবিধার কথা সংক্ষেপে বলছি। আগেই বলেছি, অস্ট্রেলিয়ান সরকার সবসময় জনগনের সুযোগ সুবিধা দেখে থাকে। এখানে উচ্চ আয়ের লোকদের যেমন উচুঁ হারে ট্যাক্স প্রদান করতে হয়, তেমনি নিম্ন আয়ের লোকদের সরকার আয় অনুপাতে তাদের সহায়তা দিয়ে থাকে। আর এই ভাবেই এ দেশে ধনী গরীবের সমতা নিশ্চিত করা হয়।
অস্ট্রেলিয়ান সরকারের সবচাইতে ভালো দিক হল ভালনারেবল পিপলদের প্রদত্ত সুযোগ সুবিধাগুলো। ডিসএবল বা প্রতিবন্ধীদের কার্যত রাষ্ট্রই সব ধরনের দ্বায়িত্ব নিয়ে নেয়। সরকার এমনকি প্রতিবন্ধীধের চাকুরীর সুযোগও করে দেয়। এছাড়া বয়স্কদের পেনশন সহ অন্যান্য দেয় সুবিধা, সিনিয়র সিটিজেনদের প্রতি রাস্ট্রের দ্বায়িত্ববোধ প্রকাশ।
এছাড়া স্টুডেন্টদের জন্য ইয়ুথ এলাউন্স, পড়াশোনা শেষে জব সিকার ভাতা (বেকার ভাতা) কিংবা প্রাকৃতিক দূর্যোগে জনগনকে আর্থিক সহায়তা সহ শতাধিক রকমের ভাতা প্রয়োজন অনুযায়ী সরকার জনগনকে দিয়ে থাকে। আর সবমিলিয়ে অস্ট্রেলিয়ানরাও সরকারের এ সহযোগিতায় ভীষণ সন্তুষ্ট।
যে কোন দেশে মাইগ্রেট করা আগে অভিবাসীরা দেশটির অর্থনৈতিক নিরাপত্তার পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টিও দেখে থাকে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো অস্ট্রেলিয়াতেও ক্রাইম বা মাদক সমস্যা রয়েছে। তবে আমার মতে তা সহনশীল পর্যায়েই। মারামারি, খুন, ডাকাতি বা ধর্ষনের মতো ঘটনাগুলোকে এ দেশে বেশ শক্ত হাতেই বিচার করা হয়। সত্য কথা বলতে কি, এখানকার ল এন্ড অর্ডার স্বাধীনভাবে কাজ করে। যার ফলে ন্যায়বিচার হয়, অপরাধীদেরও অপরাধ করে পার পাওয়ার কোন সুযোগ থাকে না।
অস্ট্রেলিয়ার বড় বড় শহর গুলোর কিছু ঘনবসতিপূর্ণ অপেক্ষাকৃত দরিদ্র এলাকাগুলো অপরাধ প্রবন হিসেবে পরিচিত। তবে মোটের উপর অস্ট্রেলিয়া কিন্তু অপেক্ষা কৃত নিরাপদ একটি দেশ। আপনি চাইলেই এ দেশে বন্দুক বা পিস্তল ব্যবহার করতে পারবেন না। আর যে কোন ভায়োলেন্সে সরকারও দাকে জিরো টলারেন্সে। তাইতো প্রতিবেশির সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কে থাকা অস্ট্রেলিয়ার কালচার।
সত্য বলতে কি, হাজারো লাইন লেখলেও দেশ অস্ট্রেলিয়া সম্পর্কে পড়ে আপনি ধারণা নিতে পারবেন না। প্রকৃত অবস্হা জানতে হলে আপনাকে এই দেশটায় কিছুদিন থাকতে হবে। আর তারপরও একেকজনের ধারনা কিন্তু একেক রকমের হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে অস্ট্রেলিয়ায় কখনোই বৈরী পরিস্হিতির মুখোমুখি হয়নি, ফলে দেশটি সম্পর্কে আমার ধারনা ইতিবাচক। কিন্তু হয়তো অনেক বাংলাদেশীদের অভিজ্ঞতা বা ধারনা আমার চেয়ে ভিন্নও হতে পারে। তবে আপাতদৃষ্টিতে বাংলাদেশী মাইগ্রেন্টদের অস্ট্রেলিয়া সম্পর্কে কোন বড় ধরনের অভিযোগ নেই বলেই আমার বিশ্বাস।
লেখাটা শেষ করবো, মাইগ্রেশনে ইচ্ছুক অনেক বন্ধুর করা কমন এ প্রশ্নটি সম্পর্কে বলে। আচ্ছা বলতো অস্ট্রেলিয়া যাবো না (কানাডা/আমেরিকা/ইউকে/………../উগান্ডায়) যাব? এই প্রশ্নের উত্তরটা কিন্তু আমার জানা নেই। সত্য বলতে কি পৃথিবীর কোন দেশের সাথে অন্য দেশের তুলনা চলে না। আপনাকেই আপনার পছন্দ বা সুবিধানুযায়ী দেশটি খুঁজে নিতে হবে। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার অভিমত অস্ট্রেলিয়াকে আপনার মাইগ্রেশন করার সম্ভাব্য দেশের শর্টলিস্টে রাখতে পারেন। তবে প্রত্যেকেরই যাচাই বাছাই শেষেই মাইগ্রেশন করার চুড়ান্ত সিদ্ধান্তটা নেওয়া উচিৎ। ভুল দেশ নির্বাচন গুড়ে বালি হয়ে যাবে।
অস্ট্রেলিয়া যে বাস করার জন্য একটি উপযুক্ত দেশ সেটা শুধু আমার মতামত নয়। বিশ্ব জনমতের ভিত্তিতে অস্ট্রেলিয়ান শহরগুলো পৃথিবীর সবচাইতে বসবাসযোগ্য শহরগুলোর লিস্টের প্রথম দিকেই থাকে। তবে আমার নিজের মতামত কিন্তু ভিন্ন। থাকার জন্য পৃথিবীর সবচাইতে সেরা দেশ হল বাংলাদেশ। তাইতো সবসময়ই স্বপ্ন দেখি সুযোগ পেলে একদিন ফিরে যাবো আমার সোনার বাংলায়।
ডিসক্লেইমার: লেখাটিতে লেখকের নিজস্ব মতামত প্রতিফলিত হয়েছে।
ইমাম হোসেন
ইমাম হোসেন। জন্ম ৩১শে মে ১৯৭৭।
আইডিয়াল স্কুল, মতিঝিল ঢাকা থেকে এসএসসি, ইলেকট্রনিক্স ও কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রী নেওয়া লেখক ইমাম হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ ফলাফলের জন্য চ্যান্সেলর স্বর্ণপদক প্রাপ্ত। পরবর্তীতে অস্ট্রেলিয়ান সরকারের সর্বোচ্চ বৃত্তি Australian Post Graduate Award (APA) নিয়ে পিএইচডি করেছেন অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলসের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং ডিসিপ্লিনে।
পেশাগত জীবনের শুরু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতা দিয়ে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তথ্যপ্রযুক্তিবিদ হিসেবে সুনামের সাথে কাজ করার ডঃ ইমাম হোসেন বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ান গভর্নমেন্টে এক্সিকিউটিভ পদে কর্মরত রয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত, দু সন্তানের জনক। সহধর্মিনী নাজিয়া হক চিকিৎসক হিসাবে কর্মরত।
লেখকের প্রকাশিত চারটি বই ই বহুল পাঠক প্রশংসিত হয়েছে। "জয়িতা" লেখকের সাড়া জাগানো উপন্যাস, "দ্বিতীয় জীবন", "মাতৃভক্তি!" আর "বহতা" এই তিনটি পাঠক সমাদৃত গল্প সংকলন। ভ্রমণপিপাসু ইমাম হোসেন তিরিশটিরও বেশি দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা লেখালেখির মাধ্যমে পাঠকের সাথে শেয়ার করে থাকেন। চাকুরী ও লেখালেখির পাশাপাশি নানা রকম সমাজ কল্যাণমূলক কার্যক্রমের সাথেও যুক্ত আছেন। পিতামহর নামে প্রতিষ্ঠিত ট্রাস্টির চেয়ারম্যান হিসেবে শিক্ষা, চিকিৎসা ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন আদি নিবাস ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বড়াইলে। Email: memam.hossain@gmail.com